Thursday, June 25, 2015

দাড়ি রাখা হারাম এই ফতোয়ার দাতভাঙা জবাব :-

★★★ শিয়াদের মধ্যে এমন এক বাতিল দল রয়েছে যারা দাড়ি রাখাকে স্পষ্ট হারাম ফতোয়া দিয়েছে।
দাড়ির ভিতর নাকি শয়তান বাস করে। কেন?
তাদের যুক্তি হল কাফির ইয়াজিদও দাড়ি রেখে নামাজ পড়ত।

জবাব : তাদের এই যুক্তি হল মাথা ব্যাথা করলে মাথা কেটে ফেলে দিন।
ইয়াজিদ দাড়ি রেখে ইমাম হোসাইন (রা) কে শহীদ করেছে ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে তাই বলে দাড়ির কি সম্পর্ক? ইয়াজিদ নামাজও পড়েছে রোজাও রেখেছে কালিমাও পড়েছে তাই বলে কি এখন তাদের যুক্তিমত নামাজ, রোজা, কালেমা সব হারাম হয়ে গেছে? আস্তাগফিরুল্লাহ ।

★★★ তাদের আরো অপবাদ দাড়ি রাসুলুল্লাহ (সা) রাখেন নি :

জবাব : এই জবাব নিচে অসংখ্য হাদিস দিয়ে দিয়েছি।

★★★ দাড়ি সম্পর্কিত হাদিস ইমাম বুখারী (রহ) এর মনগড়া নাকি :-

জবাব : আরে তোরা তো সহিহ সিত্তাকেও মানিস না,  সাহাবায়ে কেরাম (রা) গনকেও মানিস না।
ইসলামের প্রধান ৪ খলিফার মধ্যে আলী (রা) কে ছাড়া আবু বকর (রা),  উমর (রা),  উসমান (রা) ওনাদেরকে কাফির মুনাফিক বলেও অপবাদ দিস তোরা (আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ)  তোদের মধ্যে কোন দ্বীন আছে নাকি তোরা নিজে রাই কাফির, মুনাফিক। তাদের সব বাদ দিলে ইসলামের অর্ধেক দলিল শেষ বাকি রইল আল-কোরআন। আল-কোরআনে বলা আছে রাসুলের আনুগত্য করতে।
আর রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন সাহাবাগনের অনুসরন করতে আনুগত্য করতে শুধু আহলে বাইয়াত (আ) কে মানলেই রাসুলকে আর আল-কোরআনকে মানার শর্ত পুর্ন হবে না। রাসুল (সা) এর আদেশ নিষেধ সব আল্লাহর হুকুম হয়ে গেছে আল-কোরআনের আয়াত দ্বারা।

দাড়ি রাখা রাসুলুল্লাহ (সা) ও সাহাবীগনের সুন্নত। আল্লাহ আল-কোরআনে রাসুলুল্লাহ (সা) এর আনুগত্য করতে বলেছেন মানে রাসুল যা করে আমাদেরও তাই মান্য করা :


আসুন দেখি তাহলে তাদের জবাবে সুন্নাহ সম্পর্কে কিছু শরিয়তী হুকুম :


★ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন,

ولكن ربي أمرني بإعفاء لحيتي وقص شاربي

 আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন, দাড়ি লম্বা রাখার ও মোচ খাটো করার।
-আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৪৫৯-৪৬০

★ আল্লাহর রাসূল বলেছেন-

من تمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر شهيد

আমার উম্মতের ফাসাদ (আদর্শত্যাগের) সময় যে আমার সুন্নাহ (আদর্শ) কে ধারণ করবে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। (আল-হাদিস)


★ হুজুর স. বলেছেন,
যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে মুহাব্বত করল সে যেন আমাকেই মুহাব্বত করল। আর যে আমাকে মুহাব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে বসবাস করবে। (তিরমিযী শরীফ, মেশকাত- পৃ: ৩০)


★ যে আমার সুন্নাহ’র বিরাগভাজন হয়, তার আমার সাথে কোন লেনদেন নেই।” (বুখারী, ৪৬৭৫)


এ হিসেবে রাসুলের সুন্নাহ মান্য করতে হবে সেটা যেমন রাসুল (সা) এর হুকুম সেটা আল্লাহরও হুকুম :


★ “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলকে অমান্য করে, তার জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।” (সূরা জ্বিন ২৩)

★ “রাসূল তোমাদের যা কিছু দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং সে যা কিছু নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো, আল্লাহ তায়ালাকেই ভয় করো; অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তিদাতা।” (হাশর ৭)

★ বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। [সুরা ইমরান: ৩১]

★ বলুন, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না। [সুরা ইমরান: ৩২]

★ আল্লাহ এবং তার রসূলের আনুগত্য কর এবং পরস্পরে বিবাদ করো না। তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতার সৃষ্টি হবে এবং তোমাদের অবস্থার অবনতি ঘটবে। (সূরা-আনফাল-৪৫-৪৬)

★ হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না।
আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা।
[আল কুরআন (৮); ২০,২১]

★ "যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত হবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (সুরা নিসা - ১৩)

★ যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানি করবে এবং নির্ধারিত সীমালংঘন করবে,আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দাখিল করাবেন,সে তাতে চিরকাল থাকবে।(সূরা আন-নিসা-১৪)

★ হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্ আনূগত্য করো এবং রাসূলের আনূগত্য করো এবং তোমদের মধ্যে যারা বিচারক। (নির্দেশ দাতা) যদি তোমরা কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহনে বিবাদে লিপ্ত হও - তাহলে উক্ত বিষয়টির ফায়সালা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছে ন্যাস্ত করো। (সূরা নিসা - ৫৯)

★ যে রাসূলের আনূগত্য করে, সে মূলত আল্লাহর আনূগত্য করলো (সূরা নিসা - ৮০)।

★ যারা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী তদুপরি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কিছু বিশ্বাস করি কিন্তু কিছু প্রত্যাখ্যান করি এবং এরই মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায় । প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যাকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক আযাব।
[সুরা নিসা: ১৫০-১৫১]

★ "যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয়, নিঃসন্দেহে (তাদের জন্য) আল্লাহ শাস্তি অতি কঠোর। ( সূরা আনফাল - ১৩)

★ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে রাজী রাখাই অত্যাবশ্যক - যদি তারা মোমেন হয়ে থাকে। (সুরা তওবা - ৬২)।

★ তারা কি একথা অবগত নয় যে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে শক্রুতা করেছে- তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। (সূরা তওবা - ৬৩)

★ কোন বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নির্দেশ দেয়ার পর ঐ বিষয়ে কোন ঈমানদার পুরুষ এবং কোন ঈমানদার নারীর ভিন্নমত পোষন করার অধিকার নেই। (সূরা আহযাব - ৩৬)।

★ আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে - তারা স্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে পতিত হয়ে গিয়েছে। ( সুরা আহযাব - ৩৬)।

★ যারা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও পরকালের লা'নত করবেন বা অভিশপ্ত করবেন। (সুরা আহযাব - ৫৭)।

★ যারা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের বিরুদ্ধাচরন করেছে - তারা অপদস্ত হয়েছে। (সূরা - মুজাদালাহ্ - ৫)।

★ হে প্রিয় রাসূল, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী - এমন কাউকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের বিরুদ্ধাচারণকারীর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকারী রুপে পাবেন-না। (সূরা মুজাদালাহ্ - ২২)।


আনুগত্য সম্পর্কে আরো দেখুন :-

★ আলে ইমরানের ১৩২নং আয়াত
★ সূরা মায়িদাহর ৯২নং আয়াত
★ সূরা আনফালের ১নং, ২০নং
★ সুরা রা নূরের ৫৪নং ও ৫৬নং আয়াত আরো অনেক আয়াতে।

এখান থেকে স্পষ্ট যে রাসূল (সা) এর আনুগত্য করাটাও আল্লাহ্র আনুগত্যে করার মতই জরুরি। আর দাড়ি রাখার ব্যাপারে হুকুম এসেছে সহীহ হাদীসে।




এখন আসি মুল আলোচনায় রাসুল (সা) দাড়ি রেখেছেন কিনা? এটা বিশ্বাস করা শরীয়তে ওয়াজিব :-




১. হজরত ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) মোচ খাটো এবং দাড়ি লম্বা করার নির্দেশ দিতেন। (সহীহুল বুখারীঃ হাঃ নং ৫৮৯৩ , সহীহ মুসলিমঃ হাঃ নং ৬০০)


২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা করো, দাড়ি লম্বা করো, মোচ খাটো করো।
(সহীহ মুসলিম হাঃ নং ৬০২ , সহীহুল বুখারী হাঃ নং ৫৮৯২ )


৩. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা মোচ খাটো করো এবং দাড়ি নিচের দিকে ঝুলাও, অগ্নিপূজারীদের বিরোধিতা করো (সহিহ মুসলিম ১/২২২, ২৬০)।


৪. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা মোচ খাটো এবং দাড়ি লম্বা করো (সহিহ বুখারি ২/৮৭৫)।


৫. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা দাড়ি লম্বা করো, মোচ খাটো করো এবং তোমাদের চুলের সাদা রং পরিবর্তন করো। ইহুদি ও নাসারাদের সাদৃশ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকো (কানজুল উম্মাল ৬/৬৫৩)।


৬. হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ১০টি জিনিস ফিতরাত বা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ ছোট করা, দাড়ি বড় করা, মিছওয়াক করা, নাকে পানি দিয়ে তা ঝেড়ে ফেলা, নখ ছোট করা, আঙুলের গিরা ও জোড়া ধৌত করা, বগলের চুল উপড়ানো, নাভির নিচের চুল কামানো, পেশাব-পায়খানার পর পানি ব্যবহার করা। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ১০ নম্বরটি ভুলে গেছি, তবে মনে হয় তা হবে কুলি করা (সহিহ মুসলিম ১/২২৩)।


৭. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- অগ্নিপূজকরা মোচ লম্বা করে, দাড়ি নিশ্চিহ্ন করে। তাই তোমরা তাদের বিরোধিতা করো, মোচ খাটো ও দাড়ি লম্বা করো (আত তারিখুল কাবির ১/১৪০)।


৮. হজরত হাসান (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ১০টি স্বভাব এমন ছিল, যেগুলো অবলম্বন করে কওমে লুত ধ্বংস হয়ে গেছে। তার মধ্যে একটি দাড়ি কর্তন করা ও গোঁফ লম্বা করা (দুররে মনসুর ৫/৬৪৪)।


৯. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উৎবা (রা.) সূত্রে বর্ণিত- জনৈক অগ্নিপূজক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এ অবস্থায় এলো যে, তখন সে তার দাড়ি কামিয়ে ফেলেছে এবং মোচ লম্বা করে রেখেছে। এ অবস্থায় নবী (সা.) বললেন, তুমি এটা কী করেছ? সে উত্তর দিল, এটা আমাদের ধর্মে আছে। তখন নবী করিম (সা.) ইরশাদ করলেন, আমাদের ধর্মে আছে মোচ কর্তন করা এবং দাড়ি লম্বা করা (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ৮/৩৭৯)।


১০. আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ তায়ালার কিছু ফেরেশতা আছেন, যাঁদের তাসবিহ হলো এই পবিত্র ওই সত্তা, যিনি পুরুষদের দাড়ি দিয়ে সজ্জিত করেছেন আর নারীদের করেছেন সুন্দর চুলের বেণি ও খোঁপা দিয়ে (কাশফুল খিফা ১/৫৩৮, তাকমিলায়ে বাহরুর রায়েক ৮/৩৩১)।


১১. হজরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অজু করতেন, তখন এক তালু পানি নিয়ে গলার নিচে রাখতেন এবং তা দিয়ে তাঁর দাড়ি মোবারক খিলাল করতেন। আর বলতেন এভাবে আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন (আবু দাউদ, মেশকাত ১/৪৬)।


১২. হজরত আবু মা'মার (রহ.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হজরত খাব্বাব (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) কি জোহর এবং আসরের নামাজে কিরাত পাঠ করতেন? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। আমরা বললাম, আপনারা কিভাবে বুঝতেন? তিনি বলেন, তাঁর দাড়ি নড়াচড়া করার দ্বারা। (সহিহ বুখারি ১/৭৬০)।


১৩. জায়দ বিন আসলাম ,আতা ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে উপস্থিত ছিলেন, এমন সময় একজন লোক এসে হাজির হল যার মাথা এবং দাড়ি উভয়েই কামানো ছিল। আল্লাহর রাসূল (সা) হাত দিয়ে ইশারা করে তাকে চলে যেতে বললেন এবং ইংগিত করলেন যেন সে চুল এবং দাড়ি গজায়। লোকটি কিছুদিন পর তাই করল এবং আবার এসে হাজির হল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যদি নোংরা মাথা নিয়ে হাজির হও তার চেয়ে কি এই অবস্থা উত্তম নয়; যেন সে একটি শয়তান (কামানো দাড়ি ও মাথার প্রতি ইংগিত করে) ?” (মালিক, বুক ৫১, হাদীস ৫১।২।৭)

রাসূল সাঃ এর দাড়ি লম্বা ছিল। সাহাবাগণের দাড়িও লম্বা ছিল :

১৪. হযরত আলী রাঃ রাসূল সাঃ এর বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, “তিনি অনেক বড় দাড়ির অধিকারী ছিলেন। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬৩১১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৯৪৬}


১৫. হযরত জাবির বিন সামুরা রাঃ বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাড়ি ছিল বেশি বা ঘন। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬২৩০, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৭৪৫৬}


১৬. বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা রাহ. বলেন, জনৈক অগ্নিপূজক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসেছিল। তার দাড়ি মুন্ডানো ছিল ও মোচ লম্বা ছিল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটা কী?’ সে বলল, ‘এটা আমাদের ধর্মের নিয়ম।’ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কিন্তু আমাদের দ্বীনের বিধান, আমরা মোচ কাটব ও দাড়ি লম্বা রাখব।’

جاء رجل من المجوس إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم قد حلق اللحية وأطال شاربه فقال له النبي صلى الله عليه وسلم ما هذا؟ قال : هذا في ديننا، قال : لكن في ديننا أن نجز الشارب وأن نعفي اللحية.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৩/১১৬-১১৭, হাদীস : ২৬০১৩



★★★ এ কয়টি হাদিসসহ আরো বহু হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, নবী (সা.)-এর দাড়ি মোবারক লম্বা ছিল।
দাড়ির পরিমাণ কতটুকু হবে?



১. হজরত আমর ইবনে শুয়াইব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় দাড়ির নিচ ও আশপাশ থেকে মুষ্টি পরিমাণের বাইরের অংশ কাটছাঁট করতেন। (শরহু শিরআতিল ইসলাম-২৯৮)।


২. হজরত মারওয়ান ইবনে সালেমে মুকাফা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনে উমর (রা.)-কে দেখেছি, তিনি নিজের দাড়ি মুঠ করে ধরে বাকিটুকু কেটে ফেলতেন (আবু দাউদ ২/৭৬৫)।
হজরত ইবনে উমর (রা.) হজ ও উমরার সময় নিজ দাড়ি মুঠ করে ধরে বাইরের অংশটুকু কেটে ফেলতেন (সহিহ বুখারি ৭/৮৩ হা. ৫৮৯২)।


৩. আবু জুর'আ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) স্বীয় দাড়ি মুঠ করে ধরে বাইরের অংশটুকু কেটে ফেলতেন।

** ফতহুল বারি ১০/৬৩২,

** ইবনে আবী শাইবা ১৩/১১২, হাদীস : ২৫৯৯২; ২৫৯৯৯



৪  হজরত হাসান বসরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাঁরা (সাহাবিগণ ও তাবেয়ীগন) মুঠের বাইরের অংশটুকু কেটে ছোট করাকে অনুমোদন করতেন।

** মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ৫/২২৬ হা. ২৫৪৭০)।

** প্রাগুক্ত ১৩/১১২, হাদীস : ২৫৯৯৫


৫. হযরত উমর (রাঃ) তো নিজেই এক ব্যক্তির দাড়ি ধরে এক মুঠের অতিরিক্ত অংশটুকু নিজেই কেটে দিয়েছিলেন । (প্রাগুক্ত)
ইবনে উমর (রাঃ) ছিলেন রাসূলের (সাঃ) আদর্শের পুঙ্খনুভাবে এবং পূর্ণ অনুসারী । তাই তিনি যা করেছেন তা রাসূল (সাঃ) থেকেই জেনে-শুনে করেছেন ।


৬. ইবনে উমর (রাঃ) যখন হজ্ব অথবা উমরা করতেন,তখন তিনি দাড়ি মুঠ করে ধরে মুঠের বেশী অংশটুকু কেটে ফেলতেন। ( সহীহুল বুখারী হাঃ ৫৮৯২)
এখানে যদিও হজ্ব ও উমরার সময়ের কথা বলা হয়েছে ,কিন্তু মুহাদ্দিসীনরা বলেন তিনি তা সব সময়ই করতেন। এ ছাড়াও :


৭. আবু দাউদ ও নাসাঈর বর্ণনায় ইবনে উমরের (রাঃ) হজ্ব ও উমরা ছাড়া অন্য সময়েও দাড়ি এক মুঠের বেশীটুকু কেটে ফেলার কথা রয়েছে।
(ফাতহুল বারীঃ খন্ড-১০ পৃঃ ৩৬২)


৮. নাফে রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. মুষ্ঠির অতিরিক্ত দাড়ি কেটে ফেলতেন।
- প্রাগুক্ত হাদীস : ২৫৯৯৭


_____________________________



ইমামগনের বিভিন্ন ফতোয়া দাড়ি রাখা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত :-



ফক্বীহদের দৃষ্টিতে দাড়ির বিধান।

উপর্যুক্ত হাদীসগুলোর আলোকে মুসলিম উম্মাহের ফক্বীহগণ একমত যে, দাড়ি বড় করা মুসলিমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং দাড়ি মুন্ডন করা বা “একমুষ্টি” এর কম রাখা নিষিদ্ধ।
পারিভাষিক মূলনীতির আলোকে কোন কোন ফক্বীহ দাড়ি রাখা “ফরজ” বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ তা “ওয়াজিব”মত দিয়েছেন। কেউ বা “সুন্নাত” বলেছেন।


★ চতুর্থ হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ আবু আওয়ানা ইয়াকুব ইবনে ইসহক বলেন “গোঁফ কর্তন করা এবং তা ছোট করা ওয়াজিব ও দাড়ি বড় করা ওয়াজিব”। { মুসনাদে আবী আওয়ানা-১/১৬১}


★ পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ ইবনে হাযম যাহিরী আলী ইবনে আহমাদ বলেন “দাড়ি ছেড়ে দেওয়া ও গোঁফ কর্তন করা ফরজ”। {আল মুহাল্লা-২/২২০}


★ ষষ্ঠ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও মালিকী ফক্বীহ কাযী ইয়াজ বলেন যে, “দাড়ি মুন্ডন করা, কাটা বা পুড়ানো মাকরূহ। তবে দাড়ির দৈর্ঘ ও প্রস্থ থেকে কিছু কাটা ভাল। দাড়ি কাটা বা ছাটা যেমন মাকরূহ, তেমনি প্রসিদ্ধির জন্য তা বেশি বড় করাও মাকরূহ”। {ফাতহুল বারী-১০/৩৫০, নাইলুল আওতার-১/১৩৬}


★ একাদশ হিজরীতে প্রসিদ্ধ হাম্বলী ফক্বীহ মানসূর বুহুতী রহঃ বলেন যে, “দাড়ি মুন্ডন করা হারাম, এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কর্তন করা মাকরূহ নয়। {কাশশাফুল কিনা-১/৭৫}


★ একাদশ শতকে প্রসিদ্ধ হানাফী ফক্বীহ আলাউদ্দীন হাসকাফী রহ^ তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “আদ দুররুল মুখতার” এ লিখেন যে, “দাড়ি লম্বা করার সুন্নাত সম্মত পরিমাণ এক মুষ্টি। নিহায়া গ্রন্থে এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কর্তন করা ওয়াজিব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এক মুষ্টির কম পরিমাণ দাড়ি ছাটা কেউই বৈধ বলেন নি। মরক্কো অঞ্চলের কিছু মানুষ ও মেয়েদের অনুকরণপ্রিয় কিছু হিজড়া পুরুষ এরূপ সমর্বসম্মতভাবে নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হয়। {রদ্দুল মুহতার-২/৪১৭-৪৮১}




আকৃতি বিকৃতির ফতোয়া :



★ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলার ভর্ৎসনা ঐ সব পুরুষদের উপর যারা মহিলাদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে এবং ঐ সব মহিলাদের উপর আল্লাহ তাআলার ভর্ৎসনা যারা পুরুষদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৫৪৬, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৭৫০}


★ আব্দুল্লাহ বিন ইয়াজিদ আল আনসারী বর্ণিত, ” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আন-নুহবা এবং আল-মুথলা নিষেধ করেছেন।” (বুখারী, ৭ম খণ্ড, ৪২৫)


★ সুমরাহ এবং ওমরান বিন হুসেইন রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, “প্রত্যেক খুতবায় নবীজী আমাদেরকে দান করতে ও আল-মুথলা (আকার বিকৃতি) থেকে বেঁচে থাকার কথা না বলে শেষ করতেন না।” [হাদিসটি হাসান]

★ ইবন আস শাকির হতে বর্ণিত, ওমর বিন আব্দুল আযিয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “দাড়ি কামানো হল মুথলা এবং নবীর নিষেধ করা কাজের একটি হল মুথলা”।

★ ইমাম ইবন হাজম রাহিমাহুল্লাহ , তাঁর বই ‘মারাতিব আল-ইজমা’ (ঐক্যমতের স্তর) এ উল্লেখ করেন,” তাঁরা (আলেমগণ) একমত হয়েছেন যে, দাড়ি কামানো হল মুথলা এবং এটা অননুমোদিত।”


★ ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর উক্তি উল্লেখ করেন- দাড়ি মুণ্ডানোর মতো দাড়ি কাটাও হারাম (বজলুল মজহুদ ১/৩৩)।

★ শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) লেখেন- দাড়ি মুণ্ডানো হারাম। এটি পশ্চিমা ও অমুসলিম মুশরিকদের রীতি। এক মুষ্টি পর্যন্ত দাড়ি রাখা ওয়াজিব। (আশইয়াতুল লুম'আত ১/২১২)।

★ হজরত আশরাফ আলী থানভী বাওয়াদেরুন নাওয়াদেরে লেখেন- 'দাড়ি মুণ্ডানো ও কাটা হারাম। এর ওপরে উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে (২/৪৪৩)।

★ এক মুষ্টির আগে দাড়ি কাটা উম্মতের কেউ অনুমতি দেননি (তানকিহুল ফাতাওয়া আল হামেদিয়া ১/৩৫১)।

★ বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফয়জুল বারিতে উল্লেখ আছে- এক মুষ্টির কমে দাড়ি কাটা সব ইমামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হারাম (৪/৩৮০)।

Tuesday, June 23, 2015

ইয়াযীদ সম্পর্কে আহলুস- সুন্নাহ এর ফতোওয়া (পর্ব ২) :-



৯/ - ইবনে কাসীরের ভাষ্য


ইবনে কাসীর তার রচিত ‘আল-বেদায়া’ গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ১১৬৯ পৃষ্ঠায় ‘যিকরে এয়াযীদ বিন মোয়াবিয়া’ শীর্ষক অধ্যায়ে লিখেন:
”বিভিন্ন বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে এয়াযীদ দুনিয়ার কুকর্ম পছন্দ করতো; মদ্যপান করতো, গান-বাজনায় ছিল আসক্ত, দাড়িবিহীন ছেলেদের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত, ঢোল বাজাতো, কুকুর পালতো, ব্যাঙের, ভালুকের ও বানরের লড়াই লাগিয়ে দিতো। প্রতিদিন সকালে সে মদ্যপ অবস্থায় বানরকে ঘোড়ার পিঠের সাথে বেঁধে ঘোড়াকে দৌড় দিতে বাধ্য করতো।” [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৮ম খণ্ড, ১১৬৯ পৃষ্ঠা]


১০/ - ইবনে আসীরের মন্তব্য


ইবনে আসীর নিজ ’তারীখ আল-কামিল’ গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ৪৫০ পৃষ্ঠায় মুনযির ইবনে যাবীর থেকে বর্ণনা করেন:
”এটি সত্য যে এয়াযীদ আমাকে ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) দিরহাম পুরস্কারস্বরূপ দিয়েছিল, কিন্তু এটি তার প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করা হতে আমাকে রুখবে না। আল্লাহর কসম, সে একজন মাতাল।”


১১/ - ‘মাতাল’ এয়াযীদ সম্পর্কে ইবনে জাওযীর মন্তব্য


ইবনে জাওযী তাঁর ’ওয়াফা আল-ওয়াফা’ কেতাবে বলেন:
”এয়াযীদ তার চাচাতো ভাই উসমান বিন মোহাম্মদ বিন আবি সুফিয়ানকে মদীনার শাসক পদে নিয়োগ করে। উসমান উপহার সামগ্রীসহ এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে এয়াযীদের কাছে তারই আনুগত্যের শপথ নেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রতিনিধি দলের প্রত্যাবর্তনশেষে এর সদস্যরা বলেন, ‘আমরা এমন এক লোকের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি যার কোনো ধর্ম নেই; সে মদ্যপান করে, বাদ্যযন্ত্র বাজায়, গায়িকা (ভ্রষ্টা নারী) ও কুকুর সাথে রাখে। আমরা তার প্রতি আনুগত্যের শপথ প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা ঘোষণা করছি।’ আবদুল্লাহ ইবনে আবি উমরু বিন হাফস মখযুমী বলেন, ‘এয়াযীদ আমাকে উপহার সামগ্রী দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই লোক আল্লাহর একজন শত্রু এবং মদ্যপ। আমি যেভাবে আমার এমামা (পাগড়ী) মাথা থেকে সরিয়ে ফেলছি, ঠিক একইভাবে তার থেকে নিজেকে আলাদা করবো।”


১২/ - কুসতুনতুনিয়া-বিষয়ক হাদীসের অপব্যাখ্যার অপনোদন


”...তিনি মহানবী (দ:)-কে বলতে শুনেছেন, ‘নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার সাহাবীদের প্রথম দলটি বেহেশতী হবে।’ মহানবী (দ:) এর পর বলেন, ‘আমার সাহাবীদের মধ্যে প্রথম বাহিনী যারা (রোমক) সিজারের শহর (কুসতুনতুনিয়া তথা কনস্টানটিনোপোল/ইস্তাম্বুল) জয় করবে, তাদের গুনাহ মাফ করা হবে’।” [সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস - ১৭৫]

প্রথমতঃ সিজারের শহর জয়ী প্রথম বাহিনীর মধ্যে এয়াযীদ ছিল না, যেমনটি আবু দাউদের সুনানে বর্ণিত সহীহ হাদীসে বিবৃত হয়েছে: হযরত আসলাম আবি ইমরান (রা:) বলেন, “আমরা কনস্টানটিনোপোল জয়ের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে বের হই। আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান।” [সুনানে আবি দাউদ, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ২৫১২; আলবানীও এই হাদীসকে সহীহ বলেছে তার ‘তাখরিজ’ পুস্তকে]
ইমাম তাবারী নিজ ‘তারিখ’ গ্রন্থে বলেন -

আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদের সেনাপতিত্বে ৪৪ হিজরী সালে মুসলমান বাহিনী রোমে (কনস্টানটিনোপোল) প্রবেশ করেন এবং সেখানে গযওয়া (ধর্মযুদ্ধ) সংঘটিত হয়। [তারিখে তাবারী, ৪৪ হিজরীর ঘটনা, ০০৫ খণ্ড, ২১২ পৃষ্ঠা; কায়রোর ‘দারুল মা’আরিফ’ প্রকাশনী হতে প্রকাশিত]
অথচ এয়াযীদ আরও বহু পরে ওখানে যায়। উপরন্তু, তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল শাস্তিস্বরূপ; আর সে ওই প্রথমে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছিল।
ইমাম ইবনে আসীর (রহ:) লিখেন:

”এই বছর, অর্থাৎ, ৪৯ বা ৫০ হিজরী সালে হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) রোমের (কনস্টানটিনোপোল) উদ্দেশ্যে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। তিনি এর দায়িত্বভার অর্পণ করেন সুফিয়ান বিন আউফের প্রতি এবং তাঁর ছেলে এয়াযীদকে ওই বাহিনীর সাথে যেতে বলেন। কিন্তু এয়াযীদ ‘অসুস্থ হওয়ার ভান করে এবং যেতে অস্বীকৃতি জানায়’। যোদ্ধারা যখন ক্ষুধা ও রোগ-ব্যাধিগ্রস্ত হন, তখন সে ব্যঙ্গ করে কবিতায় বলে, ‘ফারকুদওয়ানা-এ মহা গযবে তারা পতিত হয়েছে; তাদের জ্বর বা অন্য যা-ই কিছু হোক, তাতে আমার যায় আসে না। কেননা, আমি বসে আছি উচ্চ ফরাশে (ম্যাট্রেস); আর আমার বাহুবন্ধনে আছে উম্মে কুলসুম (এয়াযীদের স্ত্রীদের একজন)।’

”হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) যখন এই কবিতার শ্লোক সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনি এয়াযীদকে শপথ গ্রহণ করতে ও কনস্টানটিনোপোলে সুফিয়ান ইবনে আউফের সাথে যোগ দিতে বাধ্য করেন, যাতে করে ’সেও ইসলামের মোজাহিদদের মোকাবেলাকৃত কঠিন পরীক্ষার অংশীদার হতে পারে’ (এটি এয়াযীদের প্রতি শাস্তি ছিল)। এমতাবস্থায় এয়াযীদ অসহায় হয়ে পড়ে এবং তাকে যুদ্ধে যেতে হয়; আর হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) তার সাথে আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন।” [’তারিখে ইবনে আল-আসীর’, ৩য় খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা]


ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ:) বলেন:
”আমি বলি, অসংখ্য সাহাবী (রা:) হযরত সুফিয়ান ইবনে আউফ (রা:)-এর অধীনে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং ‘এয়াযীদ ইবনে মোয়াবিয়ার নেতৃত্বে যান নি, কেননা সে তাঁদেরকে নেতৃত্বদানে অযোগ্য ছিল’।” [‘উমদাতুল কারী’, শরহে সহীহ আল-বোখারী, ১৪/১৯৭-১৯৮]



কনস্টানটিনোপোলে সেনা অভিযানের সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ:

* প্রথম আক্রমণ পরিচালিত হয় ৪২ হিজরী সালে। দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ হয় ৪৩ হিজরীতে এবং এর সেনাপতি ছিলেন হযরত বসর বিন আবি আরকা।

* তৃতীয় অভিযান পরিচালনা করা হয় ৪৪ হিজরী সালে এবং এটি নেতৃত্ব দেন আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালীদ। পরবর্তী অভিযান ছিল ৪৬ হিজরীতে যার সেনাপতি ছিলেন মালিক বিন আবদির্ রহমান ও আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালীদ।

* ৪৭ হিজরীতে পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করেন মালিক বিন হোবায়রা ও আবদুর রহমান বিন কায়েমী। ৪৯ হিজরী সালে কনস্টানটিনোপোল তিনবার আক্রমণ করা হয়। আর সর্বশেষ ৫০ হিজরীতে যে অভিযান পরিচালিত হয় তাতে এয়াযীদ যোগ দেয় ।

হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) এয়াযীদকে আটক করে সিজারের ওখানে পাঠান, কারণ সে মোজাহিদীনবৃন্দের প্রতি বিদ্রূপ করতো। তাই শাস্তিস্বরূপ তাকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল, জ্বেহাদের জন্যে নয়।

অতএব, এয়াযীদ সপ্তম সেনা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল, প্রথম অভিযানে নয় । আর বোখারী শরীফে উল্লেখিত হয়েছে, “আমার উম্মতের মধ্যে সিজারের নগরী আক্রমণকারী প্রথম সেনা দলের পাপ-পঙ্কিলতা মাফ করা হবে।”

রেফারেন্স:

আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া
ইবনে খালদুনের ইতিহাস
ইমাম ইবনে আসীরের ইতিহাস
১৩/ - এয়াযীদের কুরআন প্রত্যাখ্যান
নিচের রেফারেন্সগুলো দেখুন -
১. আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া ৮ম খণ্ড, ২০৪ পৃষ্ঠা, যিকর রাস আল-হুসাইন
২. মিনহাজ আস্ সুন্নাহ ২য় খণ্ড, ২৪৯ পৃষ্ঠা, যিকর এয়াযীদ
৩. শরহে ফেকাহে আকবর, ৭৩ পৃষ্ঠা, যিকর এয়াযীদ
৪. শরহে তাফসীরে মাযহারী, ৫ম খণ্ড, ২১ পৃষ্ঠা, সূরাহ ইবরাহীম
৫. শাযরাহ আল-যাহাব, ৬৯ পৃষ্ঠা, যিকরে শাহাদাতে হুসাইন
৬. মাকাতাহিল হুসাইন ২য় খণ্ড, ৫৮ পৃষ্ঠা, যিকরে শাহাদাতে হুসাইন
৭. তাযকিরায়ে খাওওয়াস, ১৪৮ পৃষ্ঠা
৮. তারীখে তাবারী ১১তম খণ্ড, ২১-২৩ পৃষ্ঠা, যিকর ২৮৪ হিজরী
৯. তাফসীরে রূহুল মা’আনী (সূরা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)


১৪/ - তাফসীরে রূহুল মা’আনী গ্রন্থটি এয়াযীদকে কাফের ঘোষণা করে


আল্লামা আলূসী বলেন, ”অপবিত্র এয়াযীদ রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রেসালতকে অস্বীকার করেছিল। মক্কা মোয়াযযমা ও মদীনা মোনাওয়ারার মুসলমান সর্বসাধারণ এবং মহানবী (দ:)-এর পরিবার সদস্যদের প্রতি যে (অসভ্য) আচরণ সে করেছিল, তাতে প্রমাণ হয় যে সে কাফের (অবিশ্বাসী) ছিল।”
আমীরুল মোমেনীন (খলীফা) উমর ইবনে আব্দিল আযীযের দরবারে একবার মানুষেরা এয়াযীদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় মানুষের মধ্যে কেউ একজন এয়াযীদকে ‘আমীরুল মোমেনীন’ বলে সম্বোধন করে। এতে খলীফা রাগান্বিত হয়ে ওই লোককে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি (দুশ্চরিত্র, দুরাত্মা) এয়াযীদকে আমীরুল মোমেনীন হিসেবে ডাকো?’ অতঃপর খলীফা উমর ইবনে আবদিল আযীয ওই লোককে ২০টি দোররা মারার নির্দেশ দেন। [তাহযিবুত্ তাহযিব ১ম খণ্ড, ৩৬১ পৃষ্ঠা]


১৫/ - এয়াযীদের প্রতি লা’নত তথা অভিসম্পাত দেয়ার প্রমাণ


এয়াযীদের প্রতি অভিসম্পাত দেয়ার প্রমাণ বের করা হয়েছে নিম্নবর্ণিত আয়াতটি থেকে যা আল-বরযানজি নিজ ’আল-আশয়াত’ কেতাবে এবং ইমাম হায়তামী তাঁর ‘আস্ সাওয়াইক’ পুস্তকে বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ (রহ:) হতে এই মর্মে যে, ইমাম সাহেবের পুত্র আবদুল্লাহ এয়াযীদের প্রতি লা’নত বর্ষণের পক্ষে কুরআন মজীদের কোথায় প্রামাণ্য দলিল আছে সে ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন। ইমাম আহমদ (রহ:) এর পক্ষে উদ্ধৃত করেন আল-কুরআনের বাণী: “তবে কি তোমোদের এ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে তোমরা শাসনক্ষমতা লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং আপন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরা হচ্ছে ওই সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহতা’লা অভিসম্পাত (লা’নত) দিয়েছেন...” (৪৭:২২-২৩)। বস্তুতঃ এয়াযীদ যে অপকর্ম করেছে, তার থেকে বড় কোনো ফিতনা আর হতে পারে কি? [তাফসীরে রুহুল মা’আনী, ৯ম খণ্ড, সূরা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), ২২-২৩]

ইয়াযীদ সম্পর্কে আহলুস- সুন্নাহ এর ফতোওয়া (পর্ব ১) : -



অনুবাদ করেছেন : কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
From : Ahlus-Sunnah.com

ইয়াযীদ (আল্লাহতা’লা যেন তার যা প্রাপ্য তা তাকে দেন এবং তার বাবা হযরত আমীরে মোয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি সন্তুষ্ট হন)

বর্তমানে এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে যে কিছু মানুষ আহলে বায়ত (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পরিবার সদস্য ও আত্মীয়-পরিজন)-এর প্রতি নিজেদের প্রত্যক্ষ, এমন কি পরোক্ষ ঘৃণার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ এয়াযীদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট এবং এরই ধারাবাহিকতায় তারা তাকে এক মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিত্রিত করছে। আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা এই লেখায় ইসলামের এই বিশ্বাসঘাতক (এয়াযীদ) কীভাবে ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করেছিল এবং কীভাবে সে মদীনা মোনাওয়ারাকে লণ্ডভণ্ড করে লুঠতরাজ চালিয়েছিল সে সম্পর্কে আলোকপাত করবো।

★ প্রথমতঃ আমরা মহানবী (দ:)-এর একটি সহীহ হাদীস পেশ করবো, যা মনোরম মদীনা মোনাওয়ারা নগরীকে যে সব লোক ’লণ্ডভণ্ড’ করে তাদের সম্পর্কে বর্ণনা দেয়।
ইমাম আহমদ (রহ:) হযরত সা’য়েব ইবনে খালেদ (রা:)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “যে কেউ অন্যায়ের প্রসার এবং মদীনাবাসীদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে, তার প্রতি আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত), ফেরেশতাকুলের এবং গোটা মানব জাতির (মো’মেন বান্দাদের) লা’নত-ও।”

[মুসনাদ-এ-ইমাম আহমদ হাম্বল; ইবনে কাসীর রচিত আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ২৭৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতি অনুযায়ী]

★ কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে: “নিশ্চয় যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে, তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত) দুনিয়া ও আখেরাতে এবং আল্লাহ তাদের জন্যে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [সূরা আহযাব, ৫৭ আয়াত]

মহানবী (দ:)-এর কাছে তাঁর দৌহিত্রকে নৃশংসভাবে শহীদ করা এবং তিনি যে স্থানকে হাররাম (পবিত্র) বলে ঘোষণা করেছেন ওকে তছনছ করার চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক আর কী-ই বা হতে পারে?


১/ - এয়াযীদের নানা ঘৃণ্য অপরাধ :

ইবনে কাসীর ৬৩ হিজরীর (কারবালার) ঘটনা সম্পর্কে নিজ ’তারিখ’ গ্রন্থে লিখেন:
ইবনে যুবাইর (রা:) বলেন, ওহে মানুষেরা! তোমাদের আসহাবদেরকে হত্যা করা হয়েছে - ইন্না লিল্লাহে ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
”এয়াযীদ একটি ঘৃণিত ভুল কাজ করেছে মদীনা মোনাওয়ারাকে তিন দিনের জন্যে ‘মোবাহ’ হিসেবে কার্যকর করার লক্ষ্যে মুসলিম ইবনে উকবাকে আদেশ দিয়ে। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক ভুল। অনেক সাহাবা-এ-কেরাম ও তাঁদের সন্তানদের হত্যা করা হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে এয়াযীদ আমাদের রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা:) ও তাঁর সাথীদের শহীদ করে; আর ওই তিন দিনে মদীনা মোনাওয়ারায় এমন সব গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয় যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানেন না। এয়াযীদ তার শাসনকে মুসলিম ইবনে উকবাহের প্রেরণের মাধ্যমে সংহত করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহতা’লা তার ইচ্ছাকে পুরো হতে দেন নি এবং তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ তাকে মেরে ফেলেন যেমনিভাবে তিনি আগ্রাসী শহরগুলোকে নিজ কব্জায় নিয়েছিলেন; আর নিঃসন্দেহে আল্লাহর কব্জা কঠোর ও বেদনাদায়ক।” [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৮ম খণ্ড, ২৮৩ পৃষ্ঠা]

২/ - ইবনে যিয়াদও এয়াযীদের আচরণে বিরূপ

এয়াযীদের অপরাধ এতো গর্হিত ছিল যে এমন কি তার অনুগত উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ যাকে মুসলিম ইবনে আকীল ও পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম হুসাইনের হত্যার জন্যে পাঠানো হয়েছিল, এবং যাকে পত্র মারফত এয়াযীদ বলেছিল মক্কায় গিয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:)-এর ওপর অবরোধ দিতে, সেও তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিল: ’আল্লাহর শপথ! আমি কোনো ফাসেক (পাপী এয়াযীদ)-এর খাতিরে দুটো (অপ)-কর্মতে জড়াবো না। আমি ইতোমধ্যেই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মেয়ের (ঘরের) নাতিকে হত্যা করেছি; আর এখন (সে নির্দেশ দিচ্ছে) বায়তুল হাররামের সাথে যুদ্ধ করতে।’ তবে এয়াযীদ যখন ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করে, তখন তার মা মারজানা তাকে বলেন, ‘তুমি মরো গে! তুমি এই জঘন্য অপরাধ কীভাবে করতে পারলে?’ তিনি তাকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। এয়াযীদকে জানানো হয় যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) তাঁর বিভিন্ন ভাষণে এয়াযীদ সম্পর্কে বলতেন, সে একজন জালিয়াত, মদ্যপ, নামায তরককারী ও গায়িকা (ভ্রষ্টা) নারীদের সাহচর্যে অবস্থানকারী ব্যক্তি। [ইবনে কাসীর কৃত ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’, ৮ম খণ্ড, ২৭৯ পৃষ্ঠা]


ইবনে কাসীর আরও বর্ণনা করেন:
মুসলিম ইবনে উকবা, যার অপর পরিচিতি আস্ সাইফ মুসরাফ বিন উকবা নামে (আল্লাহ এই বদ ও মূর্খ লোকের কল্যাণ না করুন, আমীন), সে এয়াযীদের আদেশে মদীনা মোনাওয়ারার আক্রমণকে ‘বৈধতা’ দিয়েছিল তিন দিনের জন্যে। আল্লাহতা’লা এয়াযীদকে ‘জাযা’ ও ’খায়র’ মন্ঞ্জুর না করুন, আমীন। সে বহু ন্যায়বান মানুষের হত্যা সংঘটন করে এবং মদীনার বিপুল মালামাল লুঠপাট করে। একাধিক বর্ণনায় এসেছে যে সে ওখানে প্রচুর ক্ষতি সাধন করে এবং অনেক ফাসাদের জন্ম দেয়। এও উল্লেখিত হয়েছে যে (সাহাবী) হযরত মুয়াফল ইবনে সানান (রা:)-কে ইবনে উকবার সামনে বেঁধে রাখা হয় এবং তারপর শহীদ করা হয়। এই সময় সে বলে, ‘তুমি এয়াযীদের বন্ধু ছিলে, কিন্তু পরে তুমি তার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছ; তাই এয়াযীদ তোমার প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন হয়েছে। [আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ২৮০ পৃষ্ঠা]



৩/ - নেতৃস্থানীয় তাবেঈ সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব (রহ:)-এর প্রতি এয়াযীদের বৈরিতা
আল-মুদাইনী (রহ:) বলেন যে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব (রহ:)-কে নিয়ে আসা হয় মুসলিম বিন উকবার সামনে। সে তাঁকে তার কাছে বায়াত (আনুগত্য) গ্রহণ করতে বলে। তিনি এর জবাবে বলেন, “আমি (শুধু) সাইয়্যেদুনা হযরত আবু বকর (রা:) ও সাইয়্যেদুনা হযরত উমর (রা:)-এর সীরাতের (আদর্শের) প্রতি বায়াত নিতে পারি।” এমতাবস্থায় ইবনে উকবা তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কেউ একজন (তাঁকে বাঁচাবার জন্যে) বলেন যে এই ব্যক্তি (হযরত সাঈদ) পাগল। এতে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। [ আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ২৮১ পৃষ্ঠা]


৪/ - শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) :-


ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) তাঁর রচিত ‘আল-এমতা’ বিল আরবাঈন’ শীর্ষক বইয়ের পুরো শিরোনামই দিয়েছেন ’এয়াযীদের প্রতি লা’নত’। ওতে তিনি লিখেন, “এয়াযীদকে ভক্তি ও তার প্রশংসা ’বেদআতী-গোমরাহ’ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই করে না, যার বিশ্বাস একেবারেই শূন্য। কেননা, এয়াযীদের এমন সব বৈশিষ্ট্য ছিল যার ভক্ত-অনুরক্ত হলে কুফর তথা অবিশ্বাসের যোগ্য হতে হয়। এটা এই কারণে যে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসা এবং তাঁরই ওয়াস্তে ঘৃণা করা ঈমানেরই লক্ষ্মণ।” [দার আল-কুতুব আল-’এলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন হতে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী প্রণীত ‘আল-’এমতা বিল্ আরবাঈন আল-মাতবাইনাত আস্ সামা’আ’ পুস্তকের ৯৬ পৃষ্ঠা]
ইমাম সাহেব (রহ:) অন্যত্র লিখেন, “এয়াহইয়া ইবনে আব্দিল মুলক্ বিন আবি গানিয়্যা যিনি ’সিকা (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারীদের একজন’, তিনি ‘সিকা’ বর্ণনাকারী নওফল বিন আবি আকরাব থেকে শুনেছেন: একবার খলীফা উমর ইবনে আবদিল আযীয (২য় উমর)-এর দরবারে মানুষেরা এয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া সম্পর্কে আলাপ করছিলেন। ওই সময় এক লোক এয়াযীদকে ‘আমীরুল মো’মেনীন’ (ঈমানদারদের শাসক) খেতাবে সম্বোধন করে। এটি শুনে খলীফা ২য় উমর (রাগান্বিত হয়ে) তাকে বলেন, “তুমি এয়াযীদকে আমীরুল মো’মেনীন ডেকেছ?” অতঃপর তিনি ওই লোককে ২০টি দোররা মারার হুকুম দেন। [ইমাম আসকালানী কৃত ‘তাহযিবুত্ তাহযিব’, ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৩১৩ পৃষ্ঠা]


৫/ - ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:) ’তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থে যা বলেন -


”আপনি (ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু) শাহাদাত বরণ করেন এবং আপনার কর্তিত শির ইবনে যিয়াদের সামনে একটি থালায় করে আনা হয়। আপনাকে যে ব্যক্তি হত্যা করেছে তার ওপর আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত); আরও লা’নত ইবনে যিয়াদ ও এয়াযীদের ওপর।” [ইমাম সৈয়ুতী রচিত ‘তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থের ১৬৫ পৃষ্ঠা]


ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) আরও লিখেন: হযরত নওফল বিন আবি ফিরায়াত (রহ:) বলেছেন যে একবার তিনি খলীফা উমর ইবনে আব্দিল আযীযের দরবারে বসেছিলেন; এমন সময় এক লোক এয়াযীদকে ‘আমীরুল মো’মেনীন’ খেতাবে সম্বোধন করে। এতে খলীফা (রাগান্বিত হয়ে) তাকে বলেন, “তুমি এই ব্যক্তিকে ’আমীরুল মো’মেনীন’ বলো?” অতঃপর তিনি ওই লোককে ২০টি দোররা মারার আদেশ দেন। ৬৩ হিজরীতে এয়াযীদ জানতে পারে যে মদীনাবাসী মুসলমানবৃন্দ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই সে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পবিত্র নগরীতে প্রেরণ করে এবং মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পবিত্র নগরী লুঠপাটের পরে সে তার বাহিনীকে পবিত্র মক্কায় পাঠায় সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:)-কে শহীদ করার জন্যে। ওই সময় ‘হোররা’-এর ঘটনা ঘটে। হোররায় কী ঘটেছিল আপনারা জানেন কি? এ প্রসঙ্গে (তাবেঈ) হযরত হাসসান বলেন, “মদীনা মোনাওয়ারায় হামলা হলে পর কেউই নিরাপদ ছিলেন না। অসংখ্য সাহাবী ও অন্যান্য মানুষ শহীদ হন এবং মদীনায় লুঠপাট হয়; আর সহস্র সহস্র কুমারী মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করা হয়। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। ... মহানবী (দ:) এরশাদ করেন: “মদীনাবাসীকে যে কেউ (সন্ত্রাসের মাধ্যমে) ভীত-সন্ত্রস্ত করলে আল্লাহ-ও তাকে অনুরূপ প্রতিদান দেবেন এবং তার ওপর আল্লাহর লা’নত, ফেরেশতাকুল ও মানব জাতির (মো’মেনদের) লা’নত-ও” (মুসলিম শরীফ)। মদীনাবাসী মুসলমানবৃন্দ যে কারণে এয়াযীদের বায়াত গ্রহণ করেন নি, তা হলো সে ’অত্যধিক পাপাচারে লিপ্ত’ ছিল। আল-ওয়াকিদী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ বিন খাযলাতাল গুসাইল (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “আল্লাহর শপথ! আমরা এয়াযীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি যখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ‘আমাদের প্রতি আসমান থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হবে’; কেননা, এয়াযীদী গোষ্ঠী তাদের মা, বোন ও কন্যাদের বিয়ে করা আরম্ভ করেছিল, প্রকাশ্যে মদ্যপান করছিল এবং নামাযও তরক করছিল।” ইমাম যাহাবী বলেন, এয়াযীদ ‘মদ্যপান ও অন্যান্য কুকর্মে লিপ্ত’ হবার পর মদীনাবাসীদের প্রতি জুলুম-নিপীড়ন করলে মক্কাবাসী মুসলমানবৃন্দও চারদিক থেকে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আল্লাহতা’লা এয়াযীদের জীবনে কোনো রহমত-বরকত দেন নি। (এয়াযীদ মক্কা আক্রমণ করে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও শহীদ করে)। [ইমাম  সৈয়ুতী প্রণীত ‘তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থের ১৬৭ পৃষ্ঠা]



৬/ - আল্লামা মাহমূদ আলূসী তাঁর কৃত ‘তাফসীরে রূহুল মা’আনী’ কেতাবে সূরা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ২২-২৩ নং আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় বলেন: “এয়াযীদের প্রতি ‘লা’নত’ দেয়ার দালিলিক প্রমাণ এই আয়াত থেকেই বের করা হয়েছে, যেমনটি ইমাম আহমদ (রহ:)-এর সূত্রে উল্লেখ করেছেন আল-বরযানজি (রহ:) নিজ ‘আল-আশআত’ পুস্তকে এবং আল-হায়তামী তাঁর ‘আস্ সাওয়াইক্ক’ গ্রন্থে এই মর্মে যে, ইমাম আহমদ (দ:)-এর পুত্র আবদুল্লাহ তাঁকে এয়াযীদের প্রতি লা’নত দেয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। ইমাম সাহেব বলেন, ‘তার প্রতি লা’নত দেয়া যাবে না কেন, যেখানে স্বয়ং আল্লাহতা’লা-ই কুরআন মজীদে তাকে লা’নত দিয়েছেন?’ আবদুল্লাহ আবার প্রশ্ন করেন, ‘কিতাবুল্লাহর ওই আয়াতটি তেলাওয়াত করুন যাতে আমি জানতে পারি কীভাবে এয়াযীদের প্রতি লা’নত দেয়া হলো?’ এমতাবস্থায় ইমাম আহমদ (রহ:) নিম্নবর্ণিত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, ‘তবে কি তোমোদের এ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে তোমরা শাসনক্ষমতা লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং আপন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরা হচ্ছে ওই সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহতা’লা অভিসম্পাত (লা’নত) দিয়েছেন...’ (আল-কুরআন, ৪৭:২২-২৩)। অতঃপর তিনি বলেন, ‘এয়াযীদ যা করেছে তার থেকে বড় বিপর্যয় আর কী হতে পারে’?” [আল্লামা আলূসী কৃত ’তাফসীরে রূহুল মা’আনী’ গ্রন্থের ৯ম খণ্ড, আল-কুরআন ৪৭:২২-২৩-এর ব্যাখ্যায়]
দ্বিতীয়তঃ আল্লামা আলূসী আরও বলেন, “আর আমি বলি, আমার ভাবনায় যা প্রাধান্য পায় তা হলো এই খবীস (এয়াযীদ) মহানবী (দ:)-এর রেসালতের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় নি। আমার মতে, এয়াযীদের মতো লোককে লা’নত দেয়া সঠিক, যদিও তার মতো এতো বড় ফাসিকের কথা কল্পনা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়; আর এটাও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সে কখনোই তওবা করে নি; (উপরন্তু) তার তওবা করার সম্ভাবনাও তার ঈমান পোষণ করার সম্ভাবনার চেয়ে ক্ষীণতর। এয়াযীদের পাশাপাশি ইবনে যিয়াদ, ইবনে সা’আদ ও তার দল-বল এতে জড়িত। অবশ্যঅবশ্য কেয়ামত দিবস অবধি এবং ইমাম হুসাইন (রা:)-এর জন্যে (মো’মেনদের) চোখের পানি যতোদিন ঝরবে ততোদিন পর্যন্ত আল্লাহর লা’নত তাদের সবার ওপর পতিত হোক; তাদের বন্ধু-বান্ধব, সমর্থক, দল-বল এবং ভক্তদের ওপরও পতিত হোক!” [তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ২৬তম খণ্ড, ৭৩ পৃষ্ঠা]


৭/ - ইমাম যাহাবীর ভাষ্য -


”এয়াযীদ ছিল এক জঘন্য নসিবী (আহলে বায়তকে ঘৃণাকারী)। সে রাজত্ব আরম্ভ করে ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করে এবং রাজত্বের ইতি টানে হাররা-এর ঘটনা দ্বারা (অর্থাৎ, মদীনা অবরোধ, যার দরুন সহীহ হাদীস মোতাবেক সে লা’নতের যোগ্য হয়)। ফলে মানুষেরা তাকে ঘৃণা করতো; অধিকন্তু সে জীবনে রহমত-বরকত কিছুই পায় নি; ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাতের পরে তার বিরুদ্ধে অনেকে অস্ত্র তুলে নেন - যেমনটি করেছিলেন মদীনাবাসীগণ, যাঁরা আল্লাহর ওয়াস্তে (তার বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়ান।” [‘সিয়্যার আল-আ’লম আন্ নুবালা’, ৪র্থ খণ্ড, ৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা]


দ্বিতীয়তঃ ইমাম যাহাবী আরও লিখেন, “আমি বলি, এয়াযীদ মদীনাবাসীদের সাথে যে আচরণ করেছিল, এবং ইমাম হুসাইন (রা:) ও তাঁর বংশধরদের যেভাবে হত্যা করেছিল, আর যেভাবে মদ্যপান ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়েছিল, তাতে মানুষেরা তাকে ঘৃণা করতেন এবং তার বিরুদ্ধে একাধিকবার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আল্লাহতা’লা এয়াযীদের জীবনে রহমত-বরকত দেন নি; উপরন্তু, আবু বিলাল মিরদাস্ বিন আদইয়া আল-হানযালী তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।” [তারিখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহির ওয়াল্ আ’লম, ০০৫ খণ্ড,৩০ পৃষ্ঠা]


তৃতীয়তঃ ইমাম যাহাবী আরও লিখেন, “যিয়াদ হারসী বর্ণনা করে: ‘এয়াযীদ আমাকে মদ পান করতে দেয়। আমি ইতিপূর্বে কখনোই এ রকম মদ পান করি নি; তাই তাকে জিজ্ঞেস করি কোথা থেকে সে এই মদের উপাদান সংগ্রহ করেছে। এয়াযীদ জবাবে বলে, এটি মিষ্টি ডালিম, ইসপাহানের মধু, হাওয়াযের চিনি, তায়েফের আঙ্গুর ও বুরদাহ-এর পানি দ্বারা প্রস্তুতকৃত।’ আহমদ ইবনে মাসামা বর্ণনা করেন: ‘একবার এয়াযীদ মদ্যপান করে নাচা আরম্ভ করে; হঠাৎ সে পড়ে যায় এবং তার নাক দিয়ে রক্ত বেরুতে আরম্ভ করে’।” [সিয়ার আল-আ’লম আন্ নুবালাহ, ০০৪ খণ্ড, ০৩৭ পৃষ্ঠা]



৮/ - এয়াযীদ সম্পর্কে কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ:)-এর ভাষ্য -


মহান মুফাসসির ও সুবিখ্যাত গ্রন্থাবলীর প্রণেতা এবং সকল সুন্নী মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলামী জ্ঞান বিশারদ কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ:) কুরআন মজীদের ১৪:২৮ আয়াতখানি উদ্ধৃত করেন: “আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি যারা অকৃজ্ঞতাবশত আল্লাহর অনুগ্রহকে বদল করেছে এবং আপন সম্প্রদায়কে ধ্বংসের ঘরে নামিয়ে এনেছে?” অতঃপর এর তাফসীরে হযরত পানিপথী (রহ:) লিখেন, “বনী উমাইয়া সব সময় কুফরীর ওপর উল্লাস প্রকাশ করেছিল; তবে আবু সুফিয়ান, আমীরে মোয়াবিয়া (রা:), আমর ইবনে আস্ এবং অন্যান্যরা মুসলমান হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এয়াযীদ ও তার সাথীরা আল্লাহর এই নেয়ামত (আশীর্বাদ) প্রত্যাখ্যান করে আহলে বায়তের প্রতি বৈরিতার পতাকা উড়ায়; আর শেষমেশ ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে সে মহানবী (দ:)-এর ধর্মকে অস্বীকার করে বসে। ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাতের পরে সে বলে: ‘আমার পূর্বপরুষেরা বেঁচে থাকলে তাঁরা আজ দেখতেন কীভাবে আমি মহানবী (দ:)-এর পরিবার ও বনী হাশেমের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছি।’ সে এ কথা ব্যক্ত করতে যে দ্বিচরণ শ্লোক ব্যবহার করে তার শেষাংশে আছে - ’বদরের যুদ্ধে আহমদ (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমার পূর্বপুরুষদের সাথে যা কিছু করেছেন, তার বদলা আমি নেবো’ (নাউযুবিল্লাহ)। সে মদ হালাল ঘোষণা করে এবং এর প্রশংসায় বলে, ‘যদি মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ধর্মে মদ হারাম হয়, তাহলে ঈসা ইবনে মরঈয়মের (আ:) ধর্মে একে জায়েয জেনো’।” [তাফসীরে মাযহারী, ৫ম খণ্ড, ২১১-২১২ পৃষ্ঠা]



যে গল্পে হৃদয় গলে (১) : হযরত সাদ সালামি (রা) এর ১টি ঘটনা :-


সাহাবীয়ে কেরাম (রা) ওনাদের ঘটনা শুনলে সত্যি চোখে পানি এসে যায় :-

হযরত সাদ সালামি আল্লাহর নবীর একজন সাহাবী ছিলেন । তিনি অত্যন্ত গরীব সাহাবী ছিলেন। গায়ের রং ছিল খুবই কালো এবং মুখের মধ্যে ছিল বসন্তের দাগ | একদিন সাদ (রা: ) রাসূলে পাকের দরবারে বসে কাঁদতে ছিলেন। হুজুর ( সা: ) তাকে কান্না করার কারন জিজ্ঞেস করলেন? জবাবে সাদ (রা: ) বলতে শুরু করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি আপনার হাতে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়েছি ৮ মাস হল। এই ৮ মাস আমি মদিনার অলিতে গলিতে কত জায়গায় ঘুরলাম বিয়ের জন্য কিন্ত আমি দেখতে অসুন্দর বলে কেউ আমাকে মেয়ে দেয়না। আমি আপনার সকল সুন্নাত পালন করতে পারলেও আপনার একটি সুন্নাত বিয়ে যা আমি পালন করতে পারিনি । তাই আমি ভয়ে কান্না করছি যদি এই সুন্নাত না মানার জন্য আল্লাহ্ আমাকে জান্নাত হতে বঞ্চিত করেন।


রাসুল (স: ) সাদকে বললেন এই মদিনার সবচেয়ে ধনী লোক আমর ইবনে ওহাবের মেয়ে মদিনার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের সাথে আমি রাসূল তোমার বিয়ে দিয়ে দিলাম। এখন তুমি আমর ইবনে ওহাবের বাড়িতে যাও এবং তাকে গিয়ে বল আমি তার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি । সাদ (রা: ) আমর ইবনে ওহাবের বাড়িতে গেলেন এবং আমর ইবনে ওহাবকে সব কিছু খুলে বললেন । সাদ (রা: ) এর কথা শুনে আমর ইবনে ওহাব খুব রাগন্নিত হয়ে তার সাথে খারাপ আচরণ করে বাড়ি হতে বের করে দিলেন ।


এদিকে আমর ইবনে ওহাবের মেয়ে ঘরের ভেতর থেকে সব শুনতে পেলেন । যখন আমর ইবনে ওহাব ঘরে ঢুকলেন তার মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো বাবা তোমাকে এত বড় সাহস কে দিল যে রাসূলের কথা অমান্য করলেন? আল্লাহর রাসূল আমার জন্য যে ছেলেকে পছন্দ করেছেন আমিও তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিলাম। মেয়ের কথা শুনে আমর ইবনে ওহাব দৌড়ে রাসূলের দরবারে গেলেন এবং রাসূলের কাছে মাফ চাইলেন। আমার দয়াল নবীজী তাকে মাফ করে দিলেন। আর সাদ (রা: ) এর বিয়ের জন্য ৬০০ দিরহাম মোহরানা ধার্য করলেন এবং বললেন এখন তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে যাও। কিন্ত সাদ (রা: ) এত গরীব ছিলেন তার পক্ষে ৬০০ দিরহাম জোগাড় করা সম্ভব ছিল না | তাই অন্যান্য সাহাবীরা মিলে সাদ (রা: ) কে সাহায্য করলেন যাতে উনি উনার স্ত্রীর মোহরানা আদায় করেও নতুন বৌয়ের জন্য কিছু সদাই করতে পারেন। ওদিকে সাদ (রা: ) বাজারে চলে গেলেন কেনাকাটা করার জন্য। যখন নতুন বৌয়ের জন্য কেনাকাটা করতে দোকানে ঢুকলেন হঠাৎ শুনতে পেলেন মদিনার বাজারে কে যেন জিহাদের ডাক দিচ্ছে ? জিহাদের ডাক শুনে সাদ (রা: ) ভাবলেন আমি সাদ ফুলের বিছানা বাসর ঘরে নতুন স্ত্রীর কাছে যাবো না আমি রাসূলের মহব্বতে জিহাদে যাবো । তাই তিনি বিয়ের টাকা খরচ করে যুদ্ধের সরঞ্জাম ক্রয় করে জিহাদে চলে গেলেন।


এদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সাদ (রা: ) একের পর এক কাফিরকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠাতে লাগলেন। যুদ্ধ করতে করতে এরকম হঠাৎ সাদ (রা: ) শাহাদাতের পেয়ালায় শরবত পান করে শহীদ হয়ে গেলেন। এদিকে যুদ্ধ শেষ হল। দূর হতে দেখা যায় কার যেন লাশ পড়ে আছে ? রাসুল (স: ) ও সাহাবীরা কাছে গিয়ে দেখলেন এ যে সাদের লাশ। মাথার লোহার টুপি ভেঙ্গে মগজ বের হয়ে গেছে আর জিহ্বা বের হয়ে আছে। সাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে রাসূল (স: ) কেঁদে দিলেন আবার পরক্ষণেই আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং আবার আকাশ হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।


একজন যুবক সাহাবী আবু লুবাবা রাসূলকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। রাসুল (স: ) বললেন আমার সাদ ফুলের বিছানা বাসর ঘরে যায়নি, আমার মহব্বতে শহীদ হয়ে গেল তাই স্নেহের কারণে আমার চোখ হতে পানি ঝড়ে পড়ল। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলাম কারণ আল্লাহ আমার সাদকে খুব সুন্দর একটা মাকাম দান করেছেন আর চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হল আমার সাদ শহীদ হয়েছে তাই আকাশের সব দরজা খুলে গিয়েছে। বেহেস্ত হতে অসংখ্য হুর দৌড়ে আসতেছে যে কার আগে কে সাদকে কোলে নিবে ? দৌড় দেওয়ার কারণে হুরদের সামনের পর্দা সরে যাচ্ছিলো যা দেখে আমি রাসূল লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

আল্লাাহু যেন আমাদের সকলের ওনার মত ঈমান নিয়া পরকালে যাবার তৌফিক দান করেন। সকলে বলি আমিন।।।

Monday, June 22, 2015

আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদার স্বরূপ বিশ্লেষণ : মুশাববিহা ও মুজাসসিমা ফেরকা (পর্ব ২) :-


মুকাতেলিয়া ফেরকা:


মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল-বালখী (মৃত:১৫০ হি:) ও তার অনুসারীদেরকে মুকাতিলিয়া ফেরকা বলা হয়। মুকাতিল ইবনে সুলাইমান তাফসীর শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলো, কিন্তু আক্বিদার ক্ষেত্রে সে ছিলো মুশাববিহা ও মুজাসসিমা। হাদীস শাস্ত্রে মুহাদ্দিসদের ঐকমত্য অনুসারে সে পরিত্যক্ত।

ইমাম যাহাবী রহ. সিয়ারু আ’লামিন নুবালাতে লিখেছেন,
أجمعوا على تركه
অর্থ: হাদীস শাস্ত্রে সে পরিত্যাক্ত হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের ইজমা হয়েছে।[১]

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান মুজাসসিমা হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তার আক্বিদা বিশ্বাস বাতিল হওয়ার ব্যাপারেও কারও দ্বিমত নেই।
ইমাম আবুল হাসান আশআরাী রহ. তার সম্পর্কে বলেন,

حكي عن أصحاب مقاتل أن الله جسم وأن له جثةً وأنه على صورة الإنسان لحم ودم وشعر وعظم وجوارح وأعضاء من يد ورجل ورأس وعينين مصمت وهو مع ذلك لا يشبه غيره ولا يشبهه غيره

অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের অনুসারীদের থেকে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তিনি মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। আল্লাহর গোশত, রক্ত, চুল, হাড্ডি ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেমন হাত, পা, মাথা ও দু’ চোখ রয়েছে। এগুলো থাকা সত্ত্বেও তিনি কারও সঙ্গে সাদৃশ্য রাখেন না এবং কেউ তার সদৃশ নয়।[২]

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর আক্বিদাগত ভ্রান্তি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ইবনে তাইমিয়া রহ. তার ওকালতি করার অনর্থক চেষ্টা করেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. মুজাসসিমা প্রীতি খুবই আশ্চর্যজনক। তিনি মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর অনর্থক ওকালতি করে লিখেছেন,

وأما مقاتل فالله أعلم بحقيقة حاله والأشعري ينقل هذه المقالات من كتب المعتزلة وفيهم انحراف عن مقاتل بن سليمان فلعلهم زادوا في النقل عنه أو نقلوا عن غير ثقة وإلا فما أظنه يصل إلى هذا الحد

অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ ভালো জানেন। ইমাম আবুল হাসান আশআরী মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের এসব বক্তব্য মু’তাজিলাদের থেকে বর্ণনা করেছে। সম্ভবত তারা মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে অতিরঞ্জন করেছে অথবা বিশ্বস্ত নয় এমন বর্ণনাকারীদের বর্ণনা গ্রহণ করেছে। নতুবা আমি মনে করি না, সে আক্বিদার ক্ষেত্রে এতোটা নি¤œ স্তরে পৌঁছেছিল।[৩]অথচ মুকাতিল ইবনে সুলাইমান মুজাসসিমা হওয়ার বিষয়টি কারও কাছে অস্পষ্ট নয়। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর এই মুজাসসিমা প্রীতি তাকে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত করেছে। মুজাসসিমাদের প্রতি এই অনর্থক প্রীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিজেও মুজাসসিমাদের আক্বিদা প্রচার করেছেন এবং সেগুলো সমর্থন করেছেন।

খতীব বাগদাদী নিজ সনদে ইমাম আবু হানিফা রহ. থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন,أتانا من المشرق رأيان خبيثان جهم معطل ومقاتل مشبه অর্থ: পূর্ব দিক থেকে আমাদের নিকট দু’টি নিকৃষ্ট মতবাদ এসেছে। ১. জাহাম ইবনে সাফওয়ান আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী অস্বীকার করে। ২. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করে।[৪]

ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর আক্বিদা বর্ণনা করে লিখেছেন,

إن الله جسم وله جثه وإنه على صورة الإنسان لحم ودم وشعر وعظم..وهو مع ذلك لا يشبه غيره، ولا يشبهه غيره

অর্থ: আল্লাহ তায়ালা শরীর ও দেহ বিশিষ্ট। তিনি মানুষের আকৃতির মতো। তার  গোশত, রক্ত, চুল ও হাড় রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এগুলো থাকলেও তিনি কারও সাথে সাদৃশ্য রাখেন না এবং কোন কিছু তার সদৃশ নয়।[৫]



মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের মতাদর্শ একটু লক্ষ্য করুন। সে আল্লাহর জন্য শরীর সাব্যস্ত করেছে। রক্ত, মাংশ সাব্যস্ত করেছে। অথচ নিজেকে বাঁচানোর জন্য বলেছে, আল্লাহ তায়ালা কারও সাথে সাদৃশ্য রাখেন না। পরবর্তী আলোচনায় মুশাববিহাদের এই প্রতারণামূলক বক্তব্য প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখতে পাবেন। তারা আল্লাহ তায়ালার জন্য মানুষের আকৃতি সাব্যস্ত করলেও সেটা সাদৃশ্য দেয়া হয় না। আল্লাহর জন্য হাড্ডি ও চুল সাব্যস্ত করলেও সাদৃশ্য দেয়া হয় না। তারা মূলত: সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার পর বলবে যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কিছুই সাদৃশ্য রাখে না। মুশাববিহারা এধরনের স্ববিরোধীতার আশ্রয় নিয়েই তাদের কুফুরী আক্বিদা সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচার করে থাকে।

ইমাম জাহাবী রহ. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে বলেন,

مقاتل بن سليمان.. متروك الحديث وقد لطخ بالتجسيم مع أنه كان من أوعية العلم بحراً في التفسيرমুকাতিল ইবনে সুলাইমান হাদীসের ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত। সে আল্লাহর শরীর সাব্যস্তের নোংরা আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলো। অথচ সে প্রচুল ইলমের অধিকারী ছিলো এবং তাফসীর শাস্ত্রে সমুদ্রের মতো গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলো।[৬]

ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিসগণের বর্ণনা অনুযায়ী মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এই নিকৃষ্ট আক্বিদায় বিশ্বাসী হওয়ার মূল কারণ ছিলো সে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের বর্ণনা গ্রহণ করতো এবং তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস চর্চা করতো। ইসরায়েলী বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে মুকাতিল ইবনে সুলাইমান আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এ প্রসঙ্গে বলেন,

كانت له كتب ينظر فيها إلا أني أرى أنه كان له علم بالقرآن

অর্থ: তার কাছে (ইহুদী-খ্রিষ্টানদের) কিছু কিতাব ছিলো, সে এগুলো দেখতো। তবে সে তাফসীর শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলো।[৭]ইমাম ইবনে হিব্বান রহ. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে বলেন,

كان يأخذ عن اليهود والنصارى علم القرآن الذي يوافق كتبهم وكان مشبها يشبه الرب بالمخلوقين. وكان مع ذلك يكذب في الحديث অর্থ: সে ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের নিকট থেকে তাফসীর শিখতো। ইহুদী-খ্রিষ্টানরা তাদের কিতাব থেকে এই তাফসীর বর্ণনা করতো। সে একজন মুশাববিহা ছিলো। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। এছাড়া সে হাদীস শাস্ত্রে মিথ্যুক ছিলো।[৮]

ইমাম আহমাদ ইবনে সাইয়ার রহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন,
مقاتل متروك الحديث كان يتكلم في الصفات بما لا تحل الرواية عنه

অর্থ: মুকাতিল ইবনে সুলাইমান হাদীসের ক্ষেত্রে পরিত্যাক্ত। আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে সে এমন সব মতবাদ প্রচার করতো যা বর্ণনা করাও বৈধ নয়।[৯]

ইমাম যাহাবী রহ. তার সম্পর্কে বলেন,ظهر بخراسان الجهم بن صفوان ودعا إلى تعطيل صفات الله عز وجل.. وظهر في خراسان في قبالته مقاتل بن سليمان المفسر وبالغ في إثبات الصفات حتى جسم وقام على هؤلاء علماء التابعين وأئمة السلف وحذروا من بدعهم

অর্থ: খোরাসানে জাহাম ইবনে সাফওয়ানের আবির্ভাব হয়। সে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার গুণাবলী অস্বীকারের প্রতি আহ্বান করে। একই সময়ে খোরাসানে মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের আবির্ভাব হয়। সে আল্লাহর গুণাবলী সাব্যস্তের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করে, এমনকি সে আল্লাহর দেহ সাব্যস্ত করে। এই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাবেয়ী ও সালাফে-সালেহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করেন এবং তাদের প্রচারিত বিদয়াত থেকে মানুষকে সচেতন করেন।[১০]

খতীব বাগদাদী রহ. তাফসীর বিষয়ে তার জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। খতীব বাগদাদী রহ. বলেন, সে মানুষের তাফসীর একত্র করে নিজের নামে চালিয়ে দিতো এবং মুফাসসিরদের কাছ থেকে শোনা ব্যতীত তাদের বর্ণনা উল্লেখ করতো।[১১]


মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের আক্বিদাগত ভ্রান্তির ব্যাপারে কোন সংশয় নেই। এ ব্যাপারে কোন ইমামের দ্বিমত নেই। মুজাসসিমাদের প্রতি অন্যায় প্রীতির কারণে ইবনে তাইমিয়া রহ. মুকাতিল ইবনে সুলাইমান সম্পর্কে যা কিছু বলেছে তার বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। নিজস্ব কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর পক্ষে এধরনের ভিত্তিহীন মন্তব্য খুবই আশ্চর্যজনক।

আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার বিষয়টি শুধু মুকাতিল ইবনে সুলাইমান এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে অনেক মুহাদ্দিসই এসব ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত এই ভ্রান্ত আক্বিদায় নিপতিত হয়েছিলো। মুহাদ্দিসরা শুধু এগুলো বর্ণনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং এগুলো তাদের আক্বিদা হিসেবে প্রচার করেছে এবং এর বিরোধীতাকারীদেরও মারাত্মক সমালোচনা করেছে। অনেকে এক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে আহলে কিতাবদের বর্ণনাগুলো রাসূল স. এর হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছে এবং এভাবেই আল্লাহর গুণাবলীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের জাল বর্ণনার উদ্ভব হয়েছে।




ইমাম শাহরাস্তানী রহ. বলেন,

وزادوا في الأخبار أكاذيب وضعوها ونسبوها إلى النبي عليه الصلاة والسلام وأكثرها مقتبس من اليهود فإن التشبيه فيهم طباع حتى قالوا اشتكت عيناه فعادته الملائكة وبكى على طوفان نوح حتى رمدت عيناه وإن العرش ليئط من تحته أطيط الرحل الجديد وإنه ليفضل من كل جانب أربعة أصابع

অর্থ: তারা আল্লাহর গুণাবলীর বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা বর্ণনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে এবং এগুলোকে রাসূল স. এর হাদীস হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। এসব বর্ণনার অধিকাংশ ইহুদীদের কাছ থেকে নেয়া। কেননা আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়ার বিষয়টি ইহুদীদের স্বভাবজাত ছিলো। এমনকি তারা বলত, আল্লাহর দুই চোখ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফেরেশতা তার শুশ্রুষা করেন। নূহ আ. এর তুফানের সময় আল্লাহ তায়ালা এতো ক্রন্দন করেন যে তার দুই চোখ ফুলে ওঠে। নতুন বাহনে আরোহণের সময় যেমন আওয়াজ হয় তেমনি আল্লাহ তায়ালা যখন আরশে আরোহণ করেন  তখন আওয়াজ হয়। তিনি আরশের চার দিক থেকে চার আঙ্গুল পরিমাণ পৃথক রয়েছেন।[১] অনেক মুহাদ্দিস ইহুদীদের এসব বর্ণনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুশাববিহাদের আক্বিদা পোষণ করতো। তাদের লিখিত আক্বিদা বিষয়ক কিতাবগুলো তাদের এই ভ্রান্তির স্পষ্ট প্রমাণ। আস-সুন্নাহ, আল-ইবানা বা আর-রদ্দু আলাল জাহমিয়া নামে তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেসব কিতাব লিখেছে এগুলো পড়লে বোঝা যায়, তারা ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা কতটা প্রভাবিত ছিলো।  এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, অনেক মুহাদ্দিস শুধু ইসরাইলী বর্ণনা একত্র করার উদ্দেশ্যে কিতাব লিখেছেন। তারা এর থেকে কোন আক্বিদা প্রমাণ করেননি এবং এর বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীদেরও সমালোচনা করেননি। আমরা সেসব মুহাদ্দিসগণ সম্পর্কে আলোচনা করছি না। বরং যেসব মুহাদ্দিস রীতিমত এগুলো দ্বারা তাদের আক্বিদা প্রমাণ করেছেন এবং এর বিপরীত আক্বিদা পোষণকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন, আমরা কেবল তাদের সম্পর্কে আলোচনা করছি।আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. বলেন,

على أنه حيث سمى كتابه (السنة) يفيد أن ما حواه  ذلك الكتاب هو العقيدة المتوارثة من الصحابة والتابعين.. فلا حاجة إلى مناقشته فيما ساقه من الأسانيد... فيتبين بذلك الفرق بين ذكر شيء في كتاب يسميه مؤلفه باسم (السنة) وبين ذكره في كتاب لا يسمى بمثل هذا الاسم، لأن الثاني لا يدل على أن جميع ما فيه مما يعتقده مؤلفه، بل قد يكون جمع فيه ما لقي من الروايات تاركاً تمحيصها للمطالع بخلاف الأول فلا نناقش المؤلف في الأسانيد بل نوجه النقد إلى المؤلف مباشرة من جهة أن ما حواه هو معتقده

অর্থ: যেহেতু সে এই কিতাবের নাম রেখেছে কিতাবুস সুন্নাহ, তার এই নামকরণ দ্বারা বোঝা যায় সে এই কিতাবে যা কিছু লিখেছে এগুলো সাহাবা ও তায়েবীগণ থেকে পরম্পরাসূত্রে বর্ণিত আক্বিদা। সুতরাং তার লিখিত কিতাবের সনদ নিয়ে আলোচনার কোন প্রয়োজন পড়ে না।  স্পষ্টত: লেখক তার কিতাব যদি আস-সুন্নাহ হিসেবে নামকরণ করে তাহলে তার মধ্যে ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য থাকে।  কেননা যারা তাদের কিতাবকে এজাতীয় নামে নামকরণ করেনি তারা বর্ণনাগুলো সংকলনের সময় তাদের আক্বিদা প্রমাণকে মুখ্য গণ্য করে না। অনেক সময় একই বিষয়ক সকল বর্ণনা একত্র করার উদ্দেশ্যে বর্ণনা উল্লেখ করে থাকে। প্রথম ব্যক্তি এর বিপরীত। সে মূলত: এসব বর্ণনা দ্বারা তার আক্বিদার প্রমাণ দিয়েছে। সুতরাং আমরা এসব বর্ণনার সনদ বিশ্লেষণ ছাড়া সরাসরি তার লেখকের আক্বিদা বিশ্লেষণ করবো, কেননা সে তার আক্বিদার কিতাবে যা কিছু লিখেছে সেটি তার আক্বিদা হিসেবেই লিখেছে। [২] যারা তাদের আক্বিদার কিতাবে ইসরাইলী বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছে তারা মূলত: এসব বর্ণনা দ্বারা তাদের আক্বিদা প্রমাণ করতে চেয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে বর্ণনা দুর্বল না সহীহ, সেটা এখানে মুখ্য নয়। বরং সে এই বর্ণনা থেকে যে আক্বিদা প্রমাণ করেছে সেটাই মুখ্য। সুতরাং যেসব মুহাদ্দিস তাদের আক্বিদার কিতাবে ইহুদীদের এসব ভ্রান্ত আক্বিদা বর্ণনা করে নিজেদের আক্বিদা প্রমাণের চেষ্টা করেছে, তাদের এসব বর্ণনার সনদ বিশ্লেষণ করার পূর্বে তাদের আক্বিদা নিযে প্রশ্ন করা হবে। জাল, যয়ীফ ও ইসরাইলী বর্ণনা দ্বারা কেউ যদি আক্বিদা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, তবে তাকে শুধু একারণে নির্দোষ বরা যাবে না যে, সে জাল বর্ণনা এনেছে। বরং এসব জাল বর্ণনা থেকে সে কী কী ভুল আক্বিদা প্রমাণ করতে চেয়েছে সেগুলোও বিশ্লেষণ করা হবে।  বিষয়টি সালাফী শায়খরাও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।


ড. রেজা বিন না’সান লিখেছেন,إن علماء السلف قد ألفوا كتباً كثيرة وقد أطلق على كثير منها اسم الإبانة.... وأحيانا يطلقون على هذه المؤلفات اسم (السنة) أو (شرح السنة) – وعد كتباً منها كتاب السنة لعبد الله بن أحمد، والسنة لابن أبي عاصم، ثم قال- ويهدف مؤلفو هذه الكتب إلى إبراز عقيدة السلف كما كانت خالصة من شوائب الفرق الأخرى وشبهها، وذلك من خلال روايتهم للآثار الواردة في هذه العقيدة. ويكاد يكون موضوع هذه الكتب ونهجها واحداً وهو كما قلنا رواية الأحاديث الواردة في جميع أبواب العقيدة السلفية وذكر عقائد السلف الصالح


অর্থ: পূর্ববর্তী আলেমগণ (আক্বিদা বিষয়ক) অনেক কিতাব লিখেছেন। তদের অনেক কিতাবের নাম আল-ইবানা। কখনও কখনও তারা এসব আক্বিদার কিতাবের নাম দিয়েছে আস-সুন্নাহ অথবা শরহুস সুন্নাহ। এজাতীয় কিতাবের মধ্যে রয়েছে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর ছেলের কিতাব আস-সুন্নাহ এবং ইবনে আবি আসেম এর লেখা আস-সুন্নাহ। এসব কিতাবের লেখকদের মূল উদ্দেশ্য হলো, সালাফে-সালেহীনের আক্বিদা বিশ্বাস সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা। অন্যান্য বাতিল ফেরকার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে সালাফে-সালেহীনের বিশুদ্ধ আকিদা বর্ণনাই ছিলো এসব কিতাব লেখার মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের আক্বিদা প্রমাণের জন্য এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সত্য কথা হলো, আক্বিদা বিষয়ক এজাতীয় সকল কিতাব রচনার পদ্ধতি একই। সেটি হলো, তারা সালাফে-সালেহীনের আক্বিদা বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট আক্বিদা ও এসম্পর্কিত হাদীস উল্লেখ করেছেন।[৩]

[১]  আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৬।

[২]  মাকালাতুল কাউসারী, পৃ৩২৬।

[৩]  ইবনে বাত্তা এর লেখা আল-ইবানা এর তাহকীক, খ.১, পৃ.৪৮।






 কাররামিয়া ফেরকা:

এই ফেরকার আক্বিদা-বিশ্বাস জানার পূর্বে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি। প্রথমত: মুশাববিহা ও মুজাসসিমাদের অন্যান্য ফেরকা সময়ের পরিবর্তনে বিলুপ্ত হলেও এই ফেরকার আক্বিদা বিশ্বাস এখনও মুসলিম সমাজে প্রচলিত। এই ফেরকার প্রবর্তকের মৃত্যুর সঙ্গে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই ফেরকার অনেক আক্বিদা-বিশ্বাসই বর্তমানে সালাফী আক্বিদার মোড়কে আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান সালাফী আক্বিদা মূলত: পূর্ববর্তী মুজাসসিমা ও মুশাববিহা আক্বিদার নতুন রূপ, যা নতুন মোড়কে সাধারণ মানুষের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ফেরকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্লোগান, কৌশলের আশ্রয় নিয়ে এই ফেরকা সাধারণ মানুষের মাঝে আক্বিদাগত ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। এই ফেরকার অনেকেই বাহ্যিক ইবাদত বন্দেগি দ্বারা সাধারণ মানুষকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতো এবং তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতো কুফুরী আক্বিদা সমূহ। এভাবে তারা ইসলামের কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুসলমানদের একটি শ্রেণীকে আক্বিদার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত করেছে। সময়ের পরিবর্তনে এদের মতাদর্শে নিত্য-নতুন মতবাদের উদ্ভব হয়েছে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে কাররামিয়া ফেরকাটি মূলত: মুসলমানদের মাঝে ইহুদী আক্বিদার প্রতিনিধিত্ব করেছে। কাররামিয়া ফেরকার উত্তরসূরী হলো বর্তমান সময়ের সালাফী ও আহলে হাদীস ফেরকা। কাররামিয়াদের ভ্রান্ত আক্বিদা-বিশ্বাস উল্লেখের পরে এদের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।কাররামিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা:কাররামিয়া ফেরকার প্রতিষ্ঠাতা হলো আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম। সে সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করে এবং সেখানেই বড় হয়। সে সিজিস্তান থেকে খোরাসানে প্রবেশ করে, পরবর্তীতে নিশাপুরে ফিরে আসে। এবং সেখানে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার শুরু করে। সিজিস্তান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নিশাপুরে গেলে সেখান থেকেও সে বিতাড়িত হয়। পরবর্তীতে সে বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থান শুরু করে। সেখানেই সে ২৫৫ হি: ইন্তেকাল করে।





ইবনে কাররাম মূলত: ইবাদত বন্দেগী ও বুযুর্গীর মাধ্যমে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতো। সে খুবই সামান্য ইলম অর্জন করেছিলো। প্রত্যেক মাযহাব থেকে কিছু কিছু নিয়ে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে। দুনিয়া বিমুখতা ও খোদাভীতি দেখিয়ে নিজের দিকে সাধারণ মানুষকে ভিড়াতো। তার এসব কৌশলের কারণে অনেক সাধারণ মানুষ তার ভক্ত হয়। এমনকি তার একদা তার অনুসারীদেরকে গ্রেপ্তার করা হলে প্রায় সত্তর হাজারী অনুসারী গ্রেপ্তার হয়।তার মৃত্যুও সময় বাইতুল মুকাদ্দাসে তার অনুসারী ছিলো প্রায় বিশ হাজার। সিজিস্তান ও খোরাসানে এরকম হাজার হাজার অনুসারী ছিলো।[১২]কাররামিয়াদের ভ্রান্ত কুফুরী আক্বিদা-বিশ্বাস:কাররামিয়াদের অনেক ফেরকা ও মতবাদ রয়েছে। ভ্রান্ত ফেরকার উপর লিখিত গ্রন্থগুলোতে এদের অনেক ফেরকার নাম পাওয়া যায়। ইমাম আবু মনসুর বাগদাদী রহ. আল-ফরকু বাইনাল ফিরাক এর মধ্যে এদের তিনটি দলে ভাগ করেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রহ. এদেরকে ছয়টি দলে বিভক্ত করেছেন। ইমাম শাহরাস্তানী রহ. এদের বারটি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা তাদের বিভিন্ন ফেরকা সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে তাদের মৌলিক আক্বিদাগুলো এখানে তুলে ধরবো।মুহাম্মাদ ইবনে কাররামের একটি মৌলিক ভ্রান্ত আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। তার দেহের একটি সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে। তার মতে আল্লাহর দেহের নিচের দিকের কেবল সীমা ও সমাপ্তি রয়েছে, যেই দিক আরশের সাথে সংশ্লিষ্ট।[১৩]ইবনে কাররামের আরেকটি আক্বিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরের অংশ স্পর্শ করে আছেন।[১৪]


ইবনে কাররামের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর স্থির হয়ে আছেন। সত্ত্বাগতভাবে তিনি উপরের দিকে রয়েছেন। আরশ হলো আল্লাহর অবস্থানের স্থান।ইবনে কাররামের নিকট আল্লাহ তায়ালা চলা-ফেরা করেন, তিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করেন, তিনি উপর থেকে নিচে অবতরণ করেন।সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইবনে কাররামের মতে আল্লাহ তায়ালার ভার বা ওজন রয়েছে। ইমাম বাগদাদী রহ. বলেন,

وأعجب من هذا كله أن ابن كرام وصف معبوده بالثقل وذلك أنه قال في كتاب عذاب القبر في تفسير قوله تعالى "إذا السماء انفطرت"  إنها انفطرت من ثقل الرحمن عليها

অর্থ: পূর্বোক্ত কুফুরী আক্বিদাগুলোর চেয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক আক্বিদা হলো মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম আল্লাহ তায়ালার জন্য ওজন বা ভার সাব্যস্ত করেছে। সে তার আজাবুল কবর বইয়ে সূরা ইনফেতার এর প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লাহর ওজন সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন (অর্থ:) যখন আসমান বিদীর্ণ হবে।[১৫] সে এর ব্যাখ্যায় লিখেছে, আসমান আল্লাহর ভারে বিদীর্ণ হবে।[১৬]ইবনে কাররামের আরেকটি কুফুরী আক্বিদা হলো, সে আল্লাহর জন্য কাইফিয়াত বা অবস্থা সাব্যস্ত করেছে। ইমাম বাগদাদী রহ. লিখেন,ثم إن ابن كرام ذكر في كتابه عذاب القبر باباً له ترجمة عجيبة فقال: باب في كيفوفية الله عز وجل، ولايدري العاقل من ماذا يتعجب أمن جسارته على إطلاق لفظ الكيفية في صفات الله عز وجل؟ أم من قبح عبارته عن الكيفية بالكيفوفية، وله من جنس هذه العبارة أشكال ৃ وقد عبر عن مكان معبوده في بعض كتبه بالحيثوثية وهذه العبارات لائقة بمذهبه السخيف

অর্থ: ইবনে কাররাম তার আজাবুল কবর নামক কিতাবে একটি আশ্চর্যজনক পরিচ্ছেদ লিখেছে। পরিচ্ছেদের নাম দিয়েছে, আল্লাহর কাইফিয়াত বা অবস্থার বর্ণনা। আমি জানি না, একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার এই পরিচ্ছেদের নাম দেখে আশ্চর্যন্বিত হবে না কি আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে কাইফিয়াত বা অবস্থা সাব্যস্তের মতো ধৃষ্টতা দেখে আশ্চর্য হবে, না কি তার নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহারে আশ্চর্য হবে? সে আরবী কাইফিয়াত শব্দ থেকে বিকৃত শব্দ কাইফুফিয়াত বানিয়েছে। সে এজাতীয় আরও অনেক বিকৃত শব্দ ব্যবহার করেছে। সে তার একটি কিতাবে আল্লাহর স্থান সাব্যস্তের জন্য হাইসুসিয়াত শব্দ ব্যবহার করেছে। এধরনের বিকৃত শব্দ শুধু তার নিকৃষ্ট মাযহাবেরই উপযুক্ত।[১৭]


মুহাম্মাদ  ইবনে কাররাম ও তার অনুসারীদের ভ্রান্ত আক্বিদাসমূহ:

ইমাম আব্দুল কাহের বাগদাদী,  ইমাম ইসফারাইনী, ও ইমাম শাহরাস্তানী রহ. মুহাম্মাদ ইবনে কাররাম ও তার অনুসারীদের আক্বিদা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। আমরা তাদের মৌলিক আক্বিদাগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছি,

১. আল্লাহ তায়ালার পরিমাপ ও সীমা রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা রয়েছে। পরিভাষা অনুযায়ী দৈঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বিশিষ্ট বস্তুকে মূলত: দেহ বলা হয়। এজন্য প্রত্যেক মুজাসসিমা আল্লাহ তায়ালার দেহ সাব্যস্ত করে থাকে।

২. আল্লাহ তায়ালাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব। এমনকি আল্লাহ তায়ালাকে স্পর্শ করা সম্ভব। কারণ তাদের মতে আল্লা তায়ালা জিসম বা দেহবিশিষ্ট। আর প্রত্যেক দেহ বিশিষ্ট বস্তু র্শ করা সম্ভব।

৩. আল্লাহ তায়ালা আরশ স্পর্শ করে আছেন। কেননা তিনি আরশের উপর বসে আছেন। তাদের কারও কারও মতে তিনি আরশ থেকে পৃথক অবস্থায় আরশের উপরে রয়েছেন।

৪.আল্লাহ তায়ালার অঙ্গ-প্রতঙ্গ রয়েছে। যেমন, হাত, চোখ, পা ইত্যাদি।

৫. অধিকাংশ মুজাসসিমার মতে আল্লাহ তায়ালা সব দিক থেকে সীমাবদ্ধ। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালা নিচের দিক তথা আরশের দিক থেকে সীমাবদ্ধ এবং আরশ ব্যতীত অন্যান্য দিকে অসীম।

৬. আল্লাহ তায়ালার শোনা, দেখা, ইলম, কুদরত মোট কথা সব গুণ নশ্বর। এগুলো আল্লাহর সত্ত্বার মাঝে সৃষ্টি হয়।

৭. আল্লাহ তায়ালার কোন কাজের জন্য নড়া-চড়া প্রয়োজন। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা কিছু করার জন্য নড়া-চড়া বা হরকত করেন। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালার নড়া-চড়াই হলো আল্লাহর কাজ।[১৮]



[১] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৭, পৃ.২০২।  বিস্তারিত জানতে দেখুন, আত-তারীখুল কাবীর, খ.৮, পৃ.১৪। আল-জারহু ওয়াত তা’দীল, খ.৭, পৃ.৩৪৫, মিজানুল ই’তেদাল, খ.৪, পৃ.১৭২।

 [২] মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.১৫২, ২০৯।


[৩] মিনহাজুস সুন্নাহ, খ.২, পৃ.৬১৮।

[৪]  তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬৪, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৭, পৃ.২০২।

 [৫] মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.২৫১।

[৬]  তাযকিরাতুল হুফফায, খ.১, পৃ.১৭৪। তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।

 [৭]  তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬১।

 [৮]  আল-মাজরুহুন, খ.২, পৃ.১৫। আরও দেখুন, ওফায়াতুল আইয়ান, খ.৫, পৃ.২৫৫,  আজ-জুয়াফা, ইবনুল জাওযী, খ.১, পৃ.১৩৬।

 [৯]  তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।

 [১০] ত্ববাকাতুল হুফফায, খ.১, পৃ.১৫৯।

 [১১] তারীখে বাগদাদ, খ.১৩, পৃ.১৬২।  তাহযীবুল কামাল, খ.২৮, পৃ.৪৩৬।

[১২] আত-তাবসীর ফিদ দীন, পৃ.৬৫। আল-মুনতাজিম, ইবনুল জাওযী, খ.১২, পৃ.৯৮।

 [১৩] আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৩, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮,  ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.১৭।

 [১৪] আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৪, আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৮।

[১৫] সূরা আল-ইনফিতার, আয়াত নং ১।

[১৬]  আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৭।

[১৭] আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০৭।

 [১৮] আল-কাশিফুস সগীর, সাইদ আব্দুল-লতিফ ফুদা, পৃ.৩১-৩২।










আল্লাহ সম্পর্কে ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদার স্বরুপ বিশ্লেষণ : মুগিরিয়া, ইউনুসিয়া,জাওয়ারিবি, শয়তানিয়া ফির্কা :


¯স্রষ্টাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে বাতিল ফেরকাসমূহ  আসমানী ধর্মসমূহের মধ্যে ¯্রষ্টাকে সৃষ্টির স্তরে নামিয়েছে ইহুদীরা। খ্রিষ্টানরা স্বয়ং সৃষ্টিকে ¯্রষ্টা বানিয়েছে। এভাবে মূল তাউহীদের আক্বিদায় মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে কুফুর-শিরকে নিপতিত হয়েছে। পরবর্তীতে মুসলমানদের অনেক বাতিল ফেরকা ইহুদী-খ্রিষ্টানদের এসব কুফুরী-শিরকী আক্বিদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদাগুলো মুসলমানদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ইহুদী বর্ণনার দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিয়ারা এসব কুফুরী আক্বিদা প্রচার করে। এদের পাশাপাশি একদল অজ্ঞ মুহাদ্দিস কুরআন-সুন্নাহের বাহ্যিক শব্দ অনুসরণের নামে ইহুদীদের এসব কুফুরী আক্বিদা প্রচার করতে থাকে।

এবাবে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদাগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদেও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এবং কুরআন সুন্নাহের অনুসরণের ধুয়ো তুলে তারা অনেক সাধারণ মানুষকেও এসব কুফুরী আক্বিদার দিকে পরিচালিত করে। আল্লাহ তায়ালার নাম ও গুণাবলী বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে এসব বাতিল ফেরকাসমূহের পরিচিতি স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক।

শিয়াদের মুজাসসিমা[১] ও মুশাববিহা[২] ফেরকা:


ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কুফুরী আক্বিদা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক শিয়া-রাফেযী আল্লাহ তায়ালার জন্য সৃষ্টির গুণাবলী সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির স্তরে নামিয়েছে। মানুষের মতো রক্ত-মাংসের প্রভূ হিেেসব গ্রহণ করেছে। বাস্তবে এরা মুসলমান দাবী করলেও এরা হিন্দুদেরই সমগোত্রীয়।


এদের নিজেদের মধ্যে অনেক দল রয়েছে। প্রত্যেক দলের এক একজন নেতা রয়েছে। এদের মতাদর্শের মধ্যে সামান্য কিছু বাহ্যিক পার্থক্য দেখা গেলেও আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য দেয়ার ক্ষেত্রে সব মতবাদই অভিন্ন। শিয়াদের মধ্যে প্রসিদ্ধ মুজাসসিমাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।হিশামিয়া:বাতিল ফেরকা বিষয়ে অভিজ্ঞ ইমাম ও ঐতিহাসিকগণ হিশামিয়া দ্বারা দু’টি বাতিল ফেরকা উদ্দেশ্য নেন। একটি ফেরকার জনক হলো, হিশাম ইবনে হাকাম (মৃত: ১৯০ হি.)। অপর ফেরকার জনক হলো, হিশাম ইবনে সালিম আল-জুয়ালিকি।[৩]

ইমাম বাগদাদী রহ. এর মতে ফেরকাটি শিয়াদের ইমামের ধ্যান-ধারণা, আল্লাহর শরীর সাব্যস্তরণের ভ্রষ্টতা এবং আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানের ক্ষেত্রে অভিন্ন। ইমাম ইসফারাইনী রহ. বলেন,وهم الأصل في التشبيهঅর্থ: আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে এই দলটি হলো মূল।[৪]

ইমাম শাহরাস্তানীর মতে হিশামিয়া মূলত: একটি ফেরকা, দুই ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। এদের মতাদর্শও এক। এরা মূলত: একজন আরেকজনের অনুগামী ছিলো।  তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদানে অগ্রগামী ছিলো হিশাব ইবনে হাকাম। হিশাব ইবনে সালেম আল-জুয়ালিকি ছিলো তার অনুগামী এবং তারা উভয়ে একই পথে হেঁটেছিলো।[৫]হিশাম ইবনে হাকাম এর উপনাম ছিলো আবু মুহাম্মাদ। সে বনী শাইবান এর আযাদকৃত গোলাম ছিলো। বাগদাদ থেকে কুফায় স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানেই বসবাস করে। সে শিয়াদের অন্যতম একজন বক্তা ছিলো। খলিফা মা’মুনের সময় সে ইন্তেকাল করে।[৬]

ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ. হিশাম ইবনে হাকাম ও তাঁর অনুসারীদের আক্বিদা বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,

الهشامية أصحاب هشام بن الحكم الرافضي، يزعمون أن معبودهم جسم له نهاية وحد طويل عريض طوله مثل عرضه، وعرضه مثل عمقه لا يوفي بعضه على بعضه. ولم يعينوا له طولاً غير الطويل. وإنما قالوا: طوله مثل عرضه على المجاز دون التحقيق، وزعموا أنه نور ساطع، له قدر من الأقدار. في مكان دون مكان. كالسبيكة الصافية كاللؤلؤة المستديرة من جميع جوانبها.ذو لون وطعم ورائحة. لونه هو طعمه، هو رائحته، ورائحته هي محسته. وهو نفسه لونه. ولم يعينوا لوناً ولا طمعاً هو غيره. وزعموا أنه هو اللون وهو الطعم، وأنه قد كان لا في مكان، ثم حدث المكان بأن تحرك الباري فحدث المكان بحركته فكان فيه. وزعم أن المكان هو العرش.وذكر أبو الهذيل في بعض كتبه أن هشام بن الحكم قال إن ربه جسم ذاهب جاء، فيتحرك تارة ويسكن أخرى، ويعقد مرة ويقوم أخرى، وإنه طويل عريض عميق، لأن ما لم يكن كذلك دخل في حد التلاشي. قال: فقلت له: فأيهما أعظم إلهك أو هذا الجبل وأومأت إلى جبل أبي قبيس قال: فقال هذا الجبل يوفي عليه، أي هو أعظم منه. وذكر ابن الراوندي أن هشام بن الحكم كان يقول: إن بين إلهه وبين الأجسام المشاهدة تشابهاً من جهة من الجهات، لولا ذلك ما دلت عليه.وحكي عنه خلاف هذا وأنه كان يقول إنه جسم ذو أبعاض لا يشبهها ولا تشبهه، وحكى عنه الجاحظ أنه قال في ربه في عام واحد خمسة أقاويل، مرة رغم أنه كالبلورة وزعم مرة أنه كالسبيكة. وزعم مرة أنه غير ذي صورة، وزعم مرة أنه بشبر نفسه سبعة أشبار، ثم رجع عن ذلك وقال هو جسم لا كالأجسام.وزعم الوراق أن بعض أصحاب هشام أجابه مرة إلى أن الله عز وجل على العرش مماس له وأنه لا يفضل عن العرش ولا يفضل العرش عنه


অর্থ: হিশাম ইবনে হাকাম শিয়ার অনুসারীদেরকে হিশামিয়া বলা হয়। তাদের আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালার শরীর রয়েছে। শরীরের সমাপ্তি ও সীমা-পরিসীমা রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ রয়েছে। আল্লাহর শরীরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের সমান। শরীরের প্রস্থ এর গভীরতার সমান। আল্লাহর শরীরের কোন অংশ একে-অপরের পরিপূরক নয়। তারা আল্লাহর জন্য দৈর্ঘ্য সাব্যস্ত করেছে কিন্তু এই দৈর্ঘ্যরে সুনিদিষ্ট কোন পরিমাণ উল্লেখ করেনি। আল্লাহর দৈর্ঘ্য তার প্রস্থের সমান এজাতীয় কথা তারা অনেক সময় রূপক অর্থে ব্যবহার করে।  তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা হলেন, একটি উজ্জ্বল আলো। এই উজ্জ্বল আলোর সুনির্দিষ্ট একটা পরিমাপ রয়েছে। এটি কোন স্থানে রয়েছে, তবে তা সুনির্দিষ্ট নয়।   তিনি উজ্জ্বল ধাতু-মিশ্রণের মতো। চতুর্দিক থেকে গোলাকার  মণি-মুক্তার উজ্জ্বল।আল্লাহর রঙ, স্বাদ ও ঘ্রাণ রয়েছে। আল্লাহর রঙ তার স্বাদের অনুরূপ। আল্লাহর রঙ তার ঘ্রাণেরও অনুরূপ। আল্লাহর ঘ্রাণ তার স্পর্শ অনুভূতির প্রকাশ। সেটিই আবার তার রঙ। তারা আল্লাহর সত্তার অতিরিক্ত কোন রঙ বা ঘ্রাণ সাব্যস্ত করেনি। বরং তাদের নিকট স্বয়ং এই রঙ ও ঘ্রাণই আল্লাহ। তাদের বিশ্বাস হলো, আদিতে আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে ছিলেন না। অত:পর আল্লাহ তায়ালা নড়া-চড়া করেন, ফলে স্থান সৃষ্টি হয়। তিনি নতুন সৃষ্ট এই স্থানে থাকেন। তাদের বিশ্বাস হলো, নতুন সৃষ্ট এই স্থান হলো আরশ।আবুল হুজাইল তার একটি কিতাবে লিখেছে, হিশাম ইবনে হাকামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই পাহাড় বড় না তোমার প্রভূ বড়। সে বলল, প্রভূ বড়। আমি তাকে আবু কুবাইস পাহাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ইবনে রাওয়ান্দী বলেন, হিশাম ইবনে হাকাম বলত, বাহ্যিক শরীর ও তার প্রভূর মাঝে একটি বিশেষ দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে। যদি এটি না থাকত, তাহলে আল্লাহর প্রমাণ পাওয়া যেত না।কেউ তার এই বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য তার থেকে বর্ণনা করেছে। সে বলত, আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিশিষ্ট সত্তা। তবে তার সঙ্গে তুলনীয় কিছু নেই এবং তিনিও কারও সাদৃশ্য রাখেন না। ইমাম জাহেয তার থেকে বর্ণনা করেন, সে একই বছরে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে পাঁচ ধরনের মতবাদ তৈরি করতো। কখনও সে বলত, আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বল মণি-মুক্তার মতো। কখনও ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা মিশ্রধাতুর মতো। কখনও  বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট নন। কখনও বলত, আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতের পরিমাপ হিসেবে সাত বিঘাত। অত:পর, এসব থেকে ফিরে এসে নতুন মতবাদ চালু করলো যে, আল্লাহ তায়ালার দেহ রয়েছে, তবে অন্যান্য দেহ এর মতো নয়।ওয়াররাক বলেন, হিশামের কিছু অনুসারী তাকে উত্তর দিয়েছিলো, আল্লাহ তায়লা আরশের উপর আরশ স্পর্শ করে আছেন। তিনি আরশ থেকে বড় নন এবং আরশও তার থেকে বড় নয়। [৭]


ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রহ. হিশাম ইবনে হাকামের আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
وكان يزعم أن الله تعالى جسم. وغيَّر مذهبه في سنة واحدة عدة تغيرات. فزعم تارة أن الله تعالى  كالسبيكة الصافية، وزعم مرة أخرى أنه كالشمع الذي من أي جانب نظرت إليه كان ذلك الجانب وجهه. واستقر رأيه عاقبة الأمر على أنه سبعة أشبار، لأن هذا المقدار أقرب إلى الاعتدال ليس بجسم، لكن صورته صورة الآدمي، وهو مركب من اليد والرجل والعين لأن أعضاءه ليست من لحم ولا دم

অর্থ: “সে বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা দেহ ও শরীর বিশিষ্ট। একই বছরে সে তার মতাদর্শ কয়েকবার পরিবর্তন করতো। কখনও ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা উজ্জ্বল মিশ্র ধাতুর মতো। কখনও বিশ্বাস করতো আল্লাহ তায়ালা মোমবাতির আলোর মতো; যেদিক থেকে দেখা হয় সেদিকেই এর মুখ থাকে। সর্বশেষ সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আল্লাহ তায়ালা সাত বিঘাত বিশিষ্ট। কেননা এই পরিমাপ ভারসাম্যের অধিক নিকটবর্তী। সর্বশেষ সে বলতো, আল্লাহ তায়ালা দেহ  বিশিষ্ট নন। তবে তিনি মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। তিনি হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। তবে তার অঙ্গ-প্রতঙ্গ রক্ত-মাংশের নয়।”[৮]


হিশাম ইবনে সালেম আল-জুয়ালেকী:ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ. হিশাম ইবনে সালিম আল-জুয়ালেকী এর আক্বিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বলেন,

الهشامية أصحاب هشام بن سالم الجواليقي يزعمون أن ربهم على صورة الإنسان، وينكرون أن يكون لحماً ودماً، ويقولون: هو نور ساطع يتلألأ بياضاً وأنه ذو حواس خمس بحواس الإنسان، له يد ورجل وأنف وأذن وعين وفم، وأنه يسمع بغير ما يبصر به، وكذلك سائر حواسه عندهم متغايرة

অর্থ: হিশাম ইবনে সালেম আল-জুয়ালেকীর অনুসারীদেরকেও হিশামিয়া বলা হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। তবে তারা আল্লাহর জন্য মানুষের মতো রক্ত-মাংশ সাব্যস্ত করে না। তারা বলে, আল্লাহ তায়ালা হলেন উজ্জ্বল আলো। যেটি উজ্জ্বল সাদা আলোয় জ্বল জ্বল করে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের মতো পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট। আল্লাহ তায়ালার হাত, পা, নাক, কান, চোখ ও মুখ রয়েছে। তিনি যা দিয়ে শ্রবণ করেন সেটি তার দর্শনের অঙ্গ থেকে ভিন্ন। এভাবে আল্লাহ তায়ালার সকল ইন্দ্রিয় ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।”[৯]


ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ. বলেন,وحكى أبو عيسى الوراق أن هشام بن سالم كان يزعم أن لربه وفرة سوداء وأن ذلك نور أسودআবু ইসা আল-ওররাক বলেন, হিশাম ইবনে সালেম বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ তায়ালার কালো গোফ রয়েছে। আর এই কালো গোফ কালো আলো বিশিষ্ট।[১০]ইমাম শাহরাস্তানী রহ. বলেন,قال إنه تعالى على صورة إنسان أعلاه مجوف وأسفله مصمت.. ليس بجسم لكن صورته صورة الآدمي وهو مركب من اليد والرجل والعين، لأن أعضاءه ليست من لحم ولا دمঅর্থ: হিশাম ইবনে সালেম এর আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট। আল্লাহর শরীরের উপরের অংশ ফাঁকা গহ্বর বিশিষ্ট এবং নিচের অংশ নিñিদ্র। আল্লাহ তায়ালা দেহ বিশিষ্ট নয়। তবে আল্লাহর আকৃতি মানুষের আকৃতির মতো। তিনি  হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা গঠিত। আল্লাহর অঙ্গ-প্রতঙ্গ রক্ত-মাংসের নয়।”[১১]



 [১] যারা আল্লাহর শরীর, দেহ ও অঙ্গ-প্রতঙ্গ সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুজাসসিমা বলে। [২] যারা আল্লাহর জন্য সৃষ্টির গুণাবলী সাব্যস্ত করে তাদেরকে মুশাববিহা বলে। [৩]  আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.৪৭। [৪] আত-তাবসীর ফিদ দিন, পৃ.২৫। [৫]  আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৪। [৬] আল-ফিহরিস্ত, ইবনে নাদীম, খ.১, পৃ.১৪১। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.৪, পৃ.৫৪৪। [৭]  মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.৩১-৩৪। তাদের মতবাদ সম্পর্কে অবগত হতে আরও দেখুন, আত-ম্বীহ ওয়ার রাদ, পৃ.২৪। আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ.২০, ৪৭।  আল-বুদউ ওয়াত তা’রীখ,  খ.৫, পৃ.১৩২। আত-তাবসীর ফিদ দীন, পৃ.২৪, ৭০। আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৪। সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খ.১০, পৃ.৫৪৪। [৮]  ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.৩৪ ও ২০৯। [৯]  মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ.৩৪ ও ২০৯। [১০]  মাকালাতুল ইসলামিয়্যিন, পৃ. ২০৯। [১১]  আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.২১০।




মুগিরিয়া ফেরকা:

মুগিরা ইবনে সাইদ আল-ইজলি (মৃত:১১৯ হি:) ও তার অনুসারীদেরকে মুগিরিয়া বলা হয়। ইমাম যাহাবী মুগিরা ইবনে সাইদ সম্পর্কে বলেন,
وكان هذا الرجل ساحراً فاجراً شيعياً خبيثاًঅর্থ: সে যাদুকর, পাপী, শিয়া ও নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলো।

মুগিরিয়া ফেরকার আক্বিদা সম্পর্কে ইমাম আব্দুল কাহের বাগদাদী রহ. বলেন,
ومنها إفراطه في التشبيه، وذلك أنه زعم أن معبوده رجل من نور على رأسه تاج من نور، وله أعضاء على صور حروف الهجاء، وأن الألف منها مثال قدميه والعين على صورة عينيه، ...ومنها أنه تكلم في بدء الخلق فزعم أن الله تعالى لما أراد أن يخلق العالم تكلم باسمه الأعظم فطار ذلك الاسم ووقع تاجاً على رأسه. وتأول على ذلك قوله تعالى: (سبح اسم ربك الأعلى) وزعم أن الاسم الأعلى إنما هو ذلك التاج. ثم إنه بعد وقوع التاج على رأسه كتب بإصبعه على كفه أعمال عباده. ثم نظر فيها فغضب من معاصيهم فعرق، فاجتمع من عرقه بحران أحدهما مالح والآخر عذب. ثم اطلع في البحر فأبصر ظله فذهب ليأخذه فطار فانتزع عيني ظله فخلق منها الشمس والقمر، وأفنى باقي ظله وقال: لا ينبغي أن يكون معي ثم خلق الخلق من البحرين فخلق الشيعة من البحر العذب النير فهم المؤمنون وخلق الكفرة وهم أعداء الشيعة من البحر المظلم المالح

অর্থ: তার ভ্রান্ত বিষয়গুলোর একটি হলো সে আল্লাহ তায়ালাকে নিকৃষ্টভাবে সৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদান করতো। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা  আলোকময় এক ব্যক্তি, যার মাথায় নূরের মুকুট রয়েছে। আরবী বর্ণমালার আকৃতি অনুযায়ী আল্লাহর আকৃতি রয়েছে। আরবী বর্ণমালার আলিফ আল্লাহর পায়ের উদাহরণ। আরবী আইন অক্ষরটি আল্লাহর চোখের অনুরূপ। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির শুরুতে কথা বলেন। সে ধারণা করতো আল্লাহ তায়ালা যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তিনি তার ইসমে আ’জম উচ্চারণ করেন। এই ইসমে আজম উড়ে গিয়ে তার মাথায় বসে এবং এটি তার মুকুট হয়। সে তার বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে পবিত্র কুরআনের আয়াত উপস্থাপন করে এর বিকৃত ব্যাখ্যা করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আপনি আপনার প্রভূর নামের পবিত্রতা বর্ণনা করুন, যিনি মহান। সে এই আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা করে বলেছে, এখানে সম্মানিত নাম দ্বারা আল্লাহর মুকুট উদ্দেশ্য। আল্লাহ তায়ালার মাথায় এই মুকুট আসার পর তিনি তার দুই আঙ্গুল দ্বারা হাতের তালুর উপরে বান্দার আমল লিপিবদ্ধ করেছেন। অত:পর তিনি এই আমলগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলান। বান্দার গোনাহ দেখে তিনি রাগান্বিত হয়ে যান। এই রাগের কারণে তিনি ঘর্মাক্ত  হয়ে যান। তার ঘাম থেকে দু’টি সমুদ্র প্রবাহিত হয়। একটি লবণাক্ত, অপরটি সুমিষ্ট। এরপর তিনি সমুদ্রের দিকে উঁকি দেন। সেখানে তিনি নিজের ছায়া দেখতে পান। তিনি সেটা ধরতে যান। কিন্তু ছায়া উড়ে যায়। এরপর তিনি তার নিজ ছায়া থেকে চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেন। অবশিষ্ট ছায়াকে তিনি নি:শেষ করে দেন। অত:পর তিনি বললেন, এগুলো আমার সাথে থাকা উচিৎ নয়। দুই সমুদ্র থেকে তিনি মাখলুককে সৃষ্টি করলেন। সুমিষ্ট পানির সমুদ্র থেকে শিয়াদেরকে সৃষ্টি করেন এবং লবণাক্ত  ও অন্ধকার সমুদ্র থেকে শিয়াদের শত্রুদেরকে সৃষ্টি করেন।”[১]



বয়ানিয়া ফেরকা:বয়ান ইবনে সাময়ান (মৃত:১১৯)  ও তার অনুসারীদেরকে বয়ানিয়া ফেরকা বলা হয়। সে কুফার অধিবাসী ছিলো। বয়ান ইবনে সাময়ানের আক্বিদা-বিশ্বাস ছিলো,

وكان يزعم أنه يعرف الاسم الأعظم، وأنه يهزم به العساكر ৃثم أنه زعم أن الإله الأزلي رجل من نور، وأنه يفنى كله غير وجهه. وتأول على ذلك قوله: (كل شيء هالك إلا وجهه) وقوله: (كل من عليها فان) وقوله (ويبقى وجه ربك) ورفِع خبر بيان هذا إلى خالد بن عبد الله القسري في زمان ولايته في العراق فاحتال عليه حتى ظفر به

অর্থ: সে বিশ্বাস করতো যে সে ইসমে আ’জম জানে। এর মাধ্যমে সে সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে বলে প্রচার করতো। তার আক্বিদা ছিলো, আল্লাহ তায়ালা নূরের তৈরি একজন লোক। আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তার এই মতের স্বপক্ষে সূরা কাসাস এর ৮৮ নং আয়াত, সূরা আর-রহমানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করতো। সূরা কাসাস এর ৮৮ নং আয়াতের অর্থ: আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। সূরা আর-রহমানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াতের অর্থ: ভূ-পৃষ্ঠের উপর যা কিছু রয়েছে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কেবল আপনার প্রভূর চেহারা অবশিষ্ট থাকবে।বয়ান ইবনে সাময়ানের এসব ভ্রান্ত আক্বিদা সম্পর্কে ইরাকের গভর্ণর খালেদ ইবনে আব্দুল্লাহ কাসারী অবগত হন। তিনি তাকে গ্রেপ্তার করে শূলিতে চড়ান। [২]

ইউনুসিয়া ফেরকা:

বিখ্যাত শিয়া ইউনুস ইবনে আব্দুর রহমান ও তার অনুসারীরা বয়ানিকা ফেরকা নামে পরিচিত। তার আক্বিদা ছিলো, ফেরেশতারা আল্লাহ তায়ালাকে বহন করে। ইমাম শাহরাস্তানী রহ. বলেন,زعم أن الملائكة تحمل العرش والعرش يحمل الرب تعالىঅর্থ: সে বিশ্বাস করতো যে ফেরেশতাগণ আরশ বহন করছে এবং আরশ আল্লাহ তায়ালাকে বহন করছে।[৩]


জাওয়ারিবি ফেরকা:    


দাউদ জাওয়ারিবি ও তার অনুসারীরা জাওয়ারিবি ফেরকা নামে পরিচিত। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,

رأس في الرافضة والتجسيم من مرامي جهنم

অর্থ: মুজাসসিমা ও শিয়াদের গুরু এক জাহান্নামী।[৪]

ইমাম শাহরাস্তানী রহ. তার আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
يحكى عن داود أنه قال: أعفوني عن الفرج واللحية، واسألوني عما وراء ذلك فإن في الأخبار ما يثبت ذلك. وقال: إن معبوده جسم ولحم ودم ومع ذلك جسم لا كالأجسام، ولحم كاللحوم  ودم لا كالدماء، وكذلك سائر الصفات، وحكي أنه قال هو أجوف من أعلاه إلى صدره مصمت ما سوى ذلك وأن له وفرةً سوداء وله شعر قطط

অর্থ: দাউদ জাওয়ারিবি থেকে বর্ণিত, সে বলতো, আমাকে আল্লাহর গুপ্তাঙ্গ  ও দাঁড়ি ছাড়া আর সব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। কেননা, হাদীসে এই দু’টো ছাড়া সব কিছু আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। সে বিশ্বাস করতো, আল্লাহ তায়ালা শরীর, রক্ত, গোশত বিশিষ্ট। এগুলো থাকা সত্ত্বেও তার শরীর অন্য কোন শরীরের মতো নয। আল্লাহর গোশত অন্য কারও গোশতের মতো নয় এবং তার রক্ত অন্য কারও রক্তের মতো নয়।  আল্লাহর অন্য সব গুণ সম্পর্কে একই কথা। তার থেকে বর্ণিত আছে, সে বলতো, আল্লাহ তায়ালা উপরের অংশ থেকে বুক পর্যন্ত ফাঁপা গহ্বর বিশিষ্ট এবং পরবর্তী অংশ ফাঁপা নয়। আল্লাহর কালো গোফ রয়েছে এবং কোকড়ানো চুল রয়েছে।[৫]



শয়তানিয়া ফেরকা:

শয়তান আত-তাক ও তার অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া ফেরকা বলা হয়। শয়তান আত-তাক এর প্রকৃত নাম হলো, মুহাম্মাদ বিন আলী আল-কুফী। সে শিয়াদের বড় একজন ইমাম  ছিলো। মুশাববিহা ও মুজাসসিমাদের আক্বিদা প্রচার করতো। সে হিশাম আল-জুয়ালেকীর অনেক মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলো।[৬]
তার আক্বিদা  সম্পর্কে ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ. বলেন,

وقال إن الله تعالى على صورة إنسان ربانيসে বলতো, আল্লাহ তায়ালা মানুষের আকৃতির অনুরূপ আকৃতি বিশিষ্ট।[৭]

ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রহ. শয়তান তাকের আক্বিদা সম্পর্কে বলেন,
الشيطانية أتباع شيطان الطاق وهم يزعمون أن الباري تعالى مستقر على العرش والملائكة يحملون العرش. وهم وإن كانوا ضعفاء بالنسبة إلى الله تعالى. لكن الضعيف قد يحمل القوي كرجل الديك التي تحمل مع دقتها جثة الديك

অর্থ: শয়তান তাকের অনুসারীদেরকে শয়তানিয়া বলা হয়। তাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশে অবস্থান করেন এবং ফেরেশতাগণ আরশ বহন করে। ফেরেশতারা যদিও আল্লাহর তুলনায় দুর্বল কিন্তু কখনও দুর্বল সবলকে বহন করতে পারে। যেমন, মোরগের পা দু’টি চিকন হওয়া সত্ত্বেও মোরগের শরীর বহন করে।[৮]

আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে রাফেযী শিয়াদের কুফুরী আক্বিদা ও তাদের বিভিন্ন ফেরকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো। এই আলোচনার মৌলিক একটি উদ্দেশ্য হলো, বর্তমানেও বিভিন্ন নামে এসব আক্বিদা আমাদের সমাজে প্রচার করা হচ্ছে সে বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয়া। ইসলামের তেরশ’ বছর আগে এসব কুফুরী আক্বিদার সূচনা হলেও এগুলো নি:শেষ হয়ে যায়নি। বরং বর্তমানে নতুনরূপ দিয়ে নতুন আঙ্গিকে মানুষকে এসব কুফুরীর দিকে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহকে এধরণের ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন।



[১] ্আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, ২৩১-২৩৩। আরও দেখুন,  আল-ফিসাল, ইবনে হাজাম, খ.৪, পৃ.১৪১। আত-তাবসীর, পৃ.৭০,  আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, শাহরাস্তানী, পৃ.১৭৬, আল-কামেল, ইবনুল আসীর, খ.৪, পৃ.৪২৯।

 [২]  আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক,  পৃ.২২৭-২২৮। বিস্তারিত জানতে দেখুন,  আল-ফিসাল, খ.৪, পৃ.১৪১। আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, পৃ.১৫৩।

 [৩]  আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৮।
 [৪] লিসানুল মিজান, খ.২, পৃ.৪২৭।

 [৫]  আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১০৫। আল-ফিসাল, খ.৪, পৃ.১৩৯।

 [৬] আল-বুদউ ওয়াত তারিখ, খ.৫, পৃ.১৩২।

 [৭]  আল-মিলালু ওয়ান নিহাল, পৃ.১৮৭।

 [৮] ই’তেকাদু ফিরাকিল মুসলিমিন, পৃ.৬৩।




Sunday, June 21, 2015

প্রশ্নোত্তরে রোজা (পর্ব ২) :-


             ৮ম অধ্যায়
সিয়াম অবস্থায় যা অবশ্য করণীয়



প্রশ্ন ১৭: সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে কী কী কাজ ও আমল অত্যাবশ্যক?


উত্তর : সিয়াম অবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় আমলসমূহ :
[১] পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করা। কোন শরয়ী উযর না থাকলে সালাত মাসজিদে গিয়ে জামাআতের সাথে আদায় করা। জামাআতে সালাত আদায়কে বিজ্ঞ ওলামায়ে কিরাম ওয়াজিব বলেছেন। যারা জামাআতের সাথে সালাত আদায় করে না তারা ২৭ গুণ সাওয়াব থেকে বঞ্চিততো হয়ই, উপরন্তু ফজর ও ঈশার জামাআত পরিত্যাগকারীকে হাদীসে মুনাফিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যারা অবহেলা করে বিনা ওযরে সালাত দেরী করে আদায় করে তার সালাত একশবার পড়লেও তা কবুল হবে না বলে উলামায়ে কিরাম মন্তব্য করেছেন। আর মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় থেকে বিরত থাকতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধ ব্যক্তিকেও অনুমতি প্রদান করেন নি।
[২] মিথ্যা না বলা।
[৩] গীবত না করা- আর তা হলো অসাক্ষাতে কারো দোষত্রুটি বা সমালোচনা করা
[৪] চোগলখোরী না করা- আর তা হলো এক জনের বিরুদ্ধে আরেকজনকে কিছু বলে ক্ষেপিয়ে তোলা ও ঝগড়া লাগিয়ে দেয়া।
[৫] ক্রয় বিক্রয় ও অন্যান্য কাজে কাউকে ধোঁকা না দেয়া। গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকা, মধুর কণ্ঠে গাওয়া যৌন উত্তেজনামূলক গান থেকে আরো বেশি সাবধান থাকা।
[৬] সকল প্রকার হারাম কাজ-কর্ম পরিহার করা।
জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,

إِذَا صُمْتَ فَلْيَصُمْ سَمْعُكَ وَبَصَرُكَ وَلِسَانُكَ عِنْدَ الْكَذِبِ وَالْمَحَارِمِ وَدَعْ عَنْكَ أَذَى الْجَارِ وَلْيَكُنْ عَلَيْكَ وَقَار وَسَكِيْنَة وَلاَ يَكُنْ يَوْمُ صَوْمِكَ وَيَوْمُ فِطْرِكَ سَوَاء

যখন তুমি রোযা রাখবে তখন যেন তোমার কর্ণ, চক্ষু এবং জিহবাও মিথ্যা ও হারাম কাজ থেকে রোযা রাখে। তুমি প্রতিবেশিকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকো। আত্মমর্যাদা ও প্রশান্তভাব যেন তোমার উপর বজায় থাকে এমন হলে তোমার রোযা রাখা ও না রাখা সমান হবে না। (ইবন আবী শাইবা : ৮৮৮০)


[৭] রোযা রাখা (ও অন্যান্য ইবাদত) একমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য করা। আল্লাহ বলেন,

﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ ... ﴾ [البينة: ٥]

‘‘মানুষকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের ইবাদত যেন শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশী করার জন্য হয়।’’ (বাইয়্যেনাহ : ৫)


[১১] সিয়াম ভঙ্গের সহায়ক কাজ-কর্ম পরিহার করা স্বামী-স্ত্রীর আলিঙ্গন, চুম্বন বা একত্রে শয়ন জায়েয হলেও তা যেন রোযা ভঙ্গের পর্যায়ে নিয়ে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা।
[১২] অন্তরে ভয় ও আশা পোষণ করা।
কোন অজানা ভুলের জন্য রোযাটি ভেঙ্গে যায় কিনা এ ধরনের ভয় থাকা এবং আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান পাবো এ আশাও পোষণ করা। অন্তরকে এ দু’য়ের মধ্যে সামঞ্জস্য করে রাখতে হবে।




৯ম অধ্যায়
সিয়ামের সুন্নাত আদব



[১] সাহরী খাওয়া।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً

(ক) তোমরা সাহরী খাও, কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে। (বুখারী : ১৯২৩; মুসলিম : ১০৯৫)

مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ

(খ) আমাদের (মুসলিমদের) ও ইয়াহূদী-নাসারাদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হল সাহরী খাওয়া। (মুসলিম : ১০৯৬)

অর্থাৎ আমরা সিয়াম পালন করি সাহরী খেয়ে, আর ইয়াহূদী-নাসারারা রোযা রাখে সাহরী না খেয়ে।

نِعْمَ سَحُورُ الْمُؤْمِنِ التَّمْرُ

(গ) মু’মিনের সাহরীতে উত্তম খাবার হল খেজুর। (আবূ দাঊদ : ২৩৪৫)

السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلاَ تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ

(ঘ) (রোযাদারদের জন্য) সাহরী হল একটি বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিও না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন। (আহামদ : ১০৭০২)

[২] সাহরী দেরী করে খাওয়া।
অর্থাৎ তা শেষ ওয়াক্তে খাওয়া উত্তম। রাতের শেষাংশে গ্রহণকৃত খাবারকে সাহরী বলা হয়।

[৩] সাহরীর সময়কে ইবাদতে কাজে লাগানো। প্রতিরাতের শেষ তৃতীয়াংশ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আরশ থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আর বান্দাদেরকে এই বলে আহবান করেন :

مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ وَمَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ

‘‘এখন যে ব্যক্তি আমার কাছে দু‘আ করবে আমি তা কবূল করব, যা কিছু আমার কাছে এখন চাইবে আমি তাকে তা দিব এবং যে আমার কাছে এখন মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দিব। (বুখারী : ৬৩২১;  মুসলিম : ৭৫৮)

অতএব তখন কুরআন অধ্যয়ন, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সালাত আদায়, তাওবাহ-ইস্তিগফার ও দু‘আ কবূলের জন্য এটা এক উত্তম সময়। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন :

﴿ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ ﴾ [الذاريات: ١٨]

‘‘তারা শেষ রাতে জেগে উঠে তাওবাহ-ইস্তিগফার করে।’’ (সূরাহ যারিয়াত-১৮)

[৪] সূর্য অস্ত যাওয়ামাত্র ইফতার করা অর্থাৎ তাড়াতাড়ি ইফতার করা। অতিরঞ্জিত সাবধানতার নামে ইফতার বিলম্ব না করা।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ

(ক) অর্থাৎ মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (বুখারী : ১৯৫৭; মুসলিম : ১০৯৮)

لاَ يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجَّلَ النَّاسُ الْفِطْرَ لِأَنَّ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى يُؤَخِّرُونَ

(খ) যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন দীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে। কেননা, ইয়াহূদী ও নাসারাদের অভ্যাস হল ইফাতর দেরীতে করা। (আবূ দাঊদ : ২৩৫৩)

ثَلاَثَةُ مِنْ أَخْلاَقِ النَّبُوَّةِ : تَعْجِيْلُ الإِفْطَارِ وَتَأْخِيْرُ السَّحُوْرِ وَوَضْعِ الْيَمِيْنِ عَلَى الشِّمِالِ فِي الصَّلاَةِ

(গ) তিনটি বিষয় নাবী চরিত্রের অংশ : সময় হওয়ামাত্র ইফতার করে ফেলা, সাহরী শেষ ওয়াক্তে খাওয়া এবং সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ১০৫)

كَانَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ -صلى الله عليه وسلم- أَسْرَعُ النَّاسَ إِفْطَارًا وَأَبْطَأُهُمْ سُحُوْرًا

(ঘ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ সকলের আগে তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন এবং সকলের চেয়ে দেরীতে সাহরী খেতেন। (মুসান্নাফ আঃ রাযযাক : ৭৫৯১)


৫. তবে পেট ভর্তি করে খাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
مَا مَلأُ ابْنُ آدَمَ وِعَاءُ بَطْنِهِ

‘‘যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খানা খায় তার ঐ পেট (আল্লাহর কাছে) একটি নিকৃষ্ট পাত্র।’’ (তিরমিযী : ২৩৮০)

সুন্নাত হল পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবার খাবে, আর তিনভাগের একভাগ পানি পান করবে। বাকী এক তৃতীয়াংশ শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য খালী রেখে দিবে। (তিরমিযী : ২৩৮০)


৬. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারের সময় নিম্নের এ দুআটি পাঠ করতেন :

ذَهَبَ الظَّمَاءُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ

অর্থ : ‘‘পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।’’ (আবূ দাউদ : ২৩৫৭, দারাকুতনী : ২২৭৯ আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)



[৭] বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা, সালাত আদায়, যিকর ও দু‘আ করা।
রমযান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস সেহেতু এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন অন্য সময়ের চেয়ে বেশি করা উচিত।
রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ

সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন (আল্লাহর কাছে) মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে, হে রব! দিনের বেলায় আমি তাকে পানাহার ও যৌন উপভোগ থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবূল কর।
কুরআনও বলবে, হে রব! (রাতে কুরআন পাঠের কারণে) রাতের নিদ্রা থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই এ পাঠকের ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ মঞ্জুর কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়েরই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (আহমাদ : ৬৫৮৯)


[৮] ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা।
তাদেরকে যাকাত, ফিত্‌রা ও সাদাকাহ দেয়া। হাদীসে এসেছে :

كَانَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- أَجْوَدَ النَّاسِ بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُونُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাযানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত। (মুসলিম : ২৩০৮)

[৯] উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা।
রমযান ধৈর্যধারনের মাস। আর সিয়াম হল এ কার্য প্রশিক্ষণের ইনিষ্টিটিউট। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَصْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ

‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, সে যেন তখন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, ‘‘আমি রোযাদার’’। (মুসলিম : ১১৫১)




১০ম অধ্যায়
نية الصوم ووقته وطريقته
সিয়ামের নিয়ত : সময় ও পদ্ধতি

প্রশ্ন ১৮: ফরয রোযার নিয়ত কখন করতে হয়?

উত্তর : ফজর উদয় হওয়ার আগেই অর্থাৎ রাতের মধ্যেই নিয়ত করে ফেলতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

مَنْ لَمْ يُجْمِعْ الصِّيَامَ قَبْلَ الْفَجْرِ فَلاَ صِيَامَ لَهُ

১. যে ব্যক্তি ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগেই সিয়াম পালনের নিয়ত করল না তার সিয়াম শুদ্ধ হল না। (আবূ দাঊদ : ২৪৫৪)

مَنْ لَمْ يَبِيْتِ الصِّيَامَ مِنَ اللَّيْلِ فَلاَ صِيَامَ لَهُ

২. যে ব্যক্তি রাতের মধ্যেই সিয়ামের নিয়ত করল না তার সিয়াম শুদ্ধ হল না। (এ নির্দেশ শুধুমাত্র ফরয রোযার ক্ষেত্রে) (নাসাঈ : ৪/১৯৬)



১১শ অধ্যায়
أقسام الصيام
সিয়ামের প্রকারভেদ


প্রশ্ন ১৮ : সিয়াম কত প্রকার ও কী কী?
উত্তর : চার প্রকার। যথা ১. ফরজ, ২. নফল, ৩. মাকরূহ ৪. হারাম।
প্রথমত : ফরয সিয়াম :
(ক) রমযান মাসের সিয়াম
(খ) কাযা সিয়াম
(গ) কাফফারার সিয়াম
(ঘ) মান্নত সিয়াম
দ্বিতীয়ত : নফল সিয়াম
(ক) শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম
(খ) যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের সিয়াম
(গ) আরাফাতের দিনের সিয়াম
(ঘ) মুহাররম মাসের সিয়াম
(ঙ) আশুরার সিয়াম
(চ) প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩. ১৪, ১৫- এ তিন দিনের সিয়াম
(ছ) সাপ্তাহিক সোম ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম
(জ) শাবান মাসের সিয়াম
(ঝ) দাঊদ (আঃ)’র সিয়াম
(ঞ) বিবাহে অসামর্থ ব্যক্তিদের সিয়াম।
তৃতীয়ত : মাকরূহ সিয়াম
(ক) হাজ্জ পালনরত অবস্থায় আরাফাতের দিনের সিয়াম
(খ) বিরতীহীনভাবে সিয়াম পালন
(গ) পানাহার বিহীন সিয়াম
(ঘ) কেবলমাত্র জুমুআর দিনের সিয়াম
(ঙ) শুধুমাত্র শনিবারে সিয়াম
চতুর্থত : হারাম সিয়াম :
(ক) দু’ ঈদের দিন এবং কুরবানীর ঈদের পরবর্তী ৩ দিন
(খ) সন্দেহ পূর্ণ দিনের (৩০শে শাবান) সিয়াম
(গ) স্বামীর বিনা অনুমতিতে স্ত্রীর নফল সিয়াম
(ঘ) মহিলাদের হায়েয নিফাসকালীন সময়ের সিয়াম
(ঙ) গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সিয়াম।




প্রশ্ন ১৯ : কেউ যদি ভুলক্রমে সামান্য কিছু খেয়ে ফেলে তবে কি তার সিয়াম ভঙ্গ হয়ে যাবে?
উত্তর : না, ভাঙ্গবে না।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إِذَا نَسِيَ فَأَكَلَ وَشَرِبَ فَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ فَإِنَّمَا أَطْعَمَهُ اللَّهُ وَسَقَاهُ

১. যদি কেউ ভুলক্রমে পানাহার করে তবে সে যেন তার সিয়াম পূর্ণ করে নেয়, কেননা আল্লাহ তা‘আলাই তাকে এ পানাহার করিয়েছেন (অর্থাৎ এতে তার রোযা ভাঙ্গেনি)। (বুখারী : ১৯৩৩; মুসলিম : ১১৫৫)

مَنْ أَفْطَرَ فِيْ رَمَضَانَ نَاسِيًا فَلاَ قَضَاءَ عَلَيْهِ وَلاَ كَفَّارَةَ

২. যে ব্যক্তি ভুল বশতঃ রমাযানের দিনে বেলায় কিছু খেয়ে ফেলল : সেজন্য কোন কাযা ও কাফফারা দিতে হবে না। (দারাকুতনী : ২৪; বায়হাকী : ৭৮৬৩)



আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَلَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٞ فِيمَآ أَخۡطَأۡتُم بِهِۦ وَلَٰكِن مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوبُكُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمًا ٥ ﴾ [الاحزاب: ٥]

‘ভুলক্রমে কোনকিছু করে ফেললে এতে কোন গুনাহ হবে না। তবে জেনে শুনে ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন অপরাধ করলে অবশ্যই এতে গুনাহ হবে। আল্লাহ তা‘আলা অতিশয় ক্ষমাশীল ও মেহেরবান’। (আহযাব : ৫)


অযু গোসলের সময় অসাবধানতা বশতঃ হঠাৎ করে কিছু পানি গলায় ঢুকে গেলে বা জোরপূর্বক খাওয়ানো হলে সিয়াম কি ভঙ্গ হয়ে যাবে?
উত্তর : না, ভঙ্গ হবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

إِنَّ اللهَ وَضعَ عَنْ أُمَّتِى الْخَطَأ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتَكْرَهُوْا عَلَيْهِ

‘‘আল্লাহ তা‘আলা আমার উম্মাতের ভুল-ভ্রান্তি ও বাধ্য হয়ে ঘটে যাওয়া পাপরাশি মাফ করে দিবেন। (ইবন মাজা : ২০৪৫)



প্রশ্ন ২০ : সিয়াম অবস্থায় কেউ যদি ইচ্ছাকৃত বমি করে তাহলে তাকে কী করতে হবে?
উত্তর : এ সিয়াম আবার কাযা করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

مَنْ ذرعه قىء فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءً وإن استقاء فليقض

যে ব্যক্তি অনিচ্ছা বমি করল তাকে উক্ত সিয়াম কাযা করতে হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বমি করল তাকে উক্ত সিয়াম অবশ্যই কাযা করতে হবে। (আবূ দাঊদ : ২৩৮০)



প্রশ্ন ২১ : ঋতুবর্তী মহিলারা কি কাযা করবে?

উত্তর : শুধুমাত্র সিয়াম কাযা করবে। সালাত কাযা করতে হবে না।

 আয়িশাহ (রা) বলেন :

كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلاَ نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلاَةِ

আমাদের (যখন) এটা ঘটত (অর্থাৎ মাসিক হতো)। তখন আমরা শুধু সিয়াম কাযা করতে আদিষ্ট হতাম। কিন্তু সালাত কাযা করতে আদিষ্ট হতাম না। (মুসলিম : ৩৩৫)



সিয়াম সম্পর্কে শরয়তী বিধান বুঝার জন্য আরো কিছু হাদিস নিম্নে দেয়া হল :

بَالِغْ فِي الاِسْتِنْشَاقِ إِلاَّ أَنْ تَكُونَ صَائِمًا

(ক) সিয়াম অবস্থায় না থাকলে অযুর সময় নাকের ভিতর উত্তমরূপে পানি টেনে নেবে। (তিরমিযী : ৭৮৮)

كان رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- يَصُبُّ الْمَاءَ عَلَى رَأْسِهِ وَهُوَ صَائِمٌ مِنْ الْعَطَشِ أَوْ مِنْ الْحَرِّ

(খ) সিয়াম অবস্থায় তাপ বা পিপাসার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার মাথায় পানি ঢালতেন। (আবূ দাঊদ : ২৩৬৫)

لاَ بَأْسَ أَن يَّذُوْقَ الْخَلَّ أَوِ الشَّيْءَ مَالَمْ يَدْخُلْ حَلْقِهِ وَهُوَ صَائِمٌ

(গ) গলার ভিতর প্রবেশ না করলে সিয়াম অবস্থায় তরকারী বা খাদ্যের স্বাদ দেখতে কোন অসুবিধা নেই। (বুখারী : ৯২৭৭)

لَمْ يَرَ أَنَسٌ وَالْحَسَنُ وَإِبْرَاهِيْمُ بِالْكُحْلِ لِلصَّائِمِ بَأْسًا

আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, হাসান ও ইবরাহীম (রহ.) সিয়াম পালনকারীদের জন্য সুরমা ব্যবহার কোনরূপ অসুবিধা মনে করতেন না। (বুখারী : ১৯২৯)

كَانَ النَّبِيُّ -صلى الله عليه وسلم- يُقَبِّلُ وَيُبَاشِرُ وَهُوَ صَائِمٌ وَلكِنْ كَانَ أَمْلَكَكُمْ لِإِرْبِهِ

(ঘ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম অবস্থায় (স্ত্রী) চুম্বন করতেন, শরীরে শরীর স্পর্শ করতেন। কেননা, তিনি তার প্রবৃত্তির (যৌন চাহিদা) উপর তোমাদের চেয়ে অধিক নিয়ন্ত্রক ছিলেন। (বুখারী : ১৯২৭) অর্থাৎ তিনি পবিত্র অন্তরে ভালবাসতেন তাই আমরা যেহেতু ওনার মত না তাই পারবও না নিজেদের নিয়ন্ত্রন রাখতে এজন্য বিরত থাকাই ভাল।

أَنَّ النَّبِيَّ -صلى الله عليه وسلم- احْتَجَمَ وَهُوَ صَائِمٌ

(ঙ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম অবস্থায় নিজের শরীরে শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (বুখারী : ১৯৩৮)




১৩শ অধ্যায়
أحكام القضاء والكفارة
সিয়ামের কাযা ও কাফফারার বিধান

প্রশ্ন ২২ : সিয়ামের কাযা ও কাফফারা কী জিনিস? এগুলো কীভাবে আদায় করতে হয়?
উত্তর : অনিচ্ছাকৃত বা উযরবশত ছুটে যাওয়া সাওমের বদলে কাযা, আর উযরছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেয়া সাওমের বদলে দিতে হয় কাফফারা। কাযা হলে সম পরিমাণ সাওম আদায় করতে হয়। আর কাফ্ফারা হলে, সাওম না রাখার কারণে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্তব্য পালন করতে হয়। কাফফারা তিন ধরনের।

(১) গোলাম আযাদ করা, আর তা সম্ভব না হলে
(২) একাধারে ৬০টি রোযা রাখা, আর সেটিও সম্ভব না হলে
(৩) ৬০ জন মিসকীনকে এক বেলা খানা খাওয়ানো।



প্রশ্ন ২৩ : যে ব্যক্তি বিনা উযরে বিনা করণে অতীতে সিয়াম ভঙ্গ করেছে সে কীভাবে কাযা ও কাফফারা আদায় করবে?
উত্তর : এক রমযানের সাওম তাকে পরবর্তী রমযানের আগে আদায় করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে সারা জীবনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা কাযা করে নিতে হবে। এবং প্রতি রোযার বদলে একটি রোযা পালন করতে হবে। আর তা রাখতে শারীরিকভাবে অক্ষম হলে একজন মিসকীনকে এক বেলা খানা খাওয়াতে হবে।



প্রশ্ন ২৪ : সিয়াম পালনে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু রোগীর কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই- কি করবে?
উত্তর : এ রোগী সিয়াম ভেঙ্গে ফেলবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার প্রতি অতিশয় দয়ালু। অবশ্য পরে এটা কাযা করে নেবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

‘‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ (রমযান) মাস পাবে, সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে আর যে পীড়িত কিংবা সফরে আছে, সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টদায়ক তা চান না যেন তোমরা মেয়াদ পূর্ণ করতে পার। (বাকারা : ১৮৫)



১৩শ অধ্যায়
অতি বৃদ্ধ, অচল ও চিররোগীদের সিয়াম


﴿ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
অর্থাৎ ‘‘শক্তিহীনদের উপর কর্তব্য হচ্ছে ফিদ্য়া প্রদান করা, এটা একজন মিসকীনকে অন্নদান করা।’’ (আল-বাকারা : ১৮৪)



১৪শ অধ্যায়
মুসাফিরের সিয়াম

প্রশ্ন ২৫ : মুসাফির কাকে বলে?
উত্তর : যে ব্যক্তি ভ্রমণ বা সফর করে তাকে সফররত অবস্থায় মুসাফির বলে। আবার যখন নিজ বাড়ী বা বাসভবনে চলে আসে তখন শরীয়াতের পরিভাষায় তাকে বলে মুকীম। মুকীম অর্থ হলো নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী ব্যক্তি অর্থাৎ মুসাফির নন।

পশ্ন ২৬ : কমপক্ষে কী পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করলে অর্থাৎ সফর করলে একজন ভ্রমণকারী বা যাত্রীকে মুসাফির বলা যায়?
উত্তর : হানাফী মাযহাবে কমপক্ষে ৪৮ মাইল। অন্যান্য মাযহাবে সফরের নিম্নতম দূরত্ব আরো কম।

প্রশ্ন ২৭: মুসাফির অবস্থায় সিয়াম ও সালাতের নিয়ম কি?
উত্তর : মুসাফির অবস্থায় সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয এবং চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয সালাতগুলো ২ রাকআত করে পড়বে। সে সময় ফরয নামাযের আগে বা পরে যে সমস্ত সুন্নাতে রাতেবাহ আছে সেগুলো পড়তে হবে না।



প্রশ্ন ২৮ : মুসাফিরের রোযা ভঙ্গ করলে পরবর্তীকালে তা কাযা করবে কি না?
উ: হ্যাঁ, কাযা করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤]

‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ কিংবা মুসাফির সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করে (কাযা করে) নিবে। (বাকারা : ১৮৪)

প্রশ্ন ২৯: সফরে সিয়াম ভঙ্গ করা কি বাধ্যতামূলক নাকি ইচ্ছাধীন?
উত্তর : ইচ্ছাধীন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

صُمْ إِنْ شِئْتَ وَأَفْطِرْ إِنْ شِئْتَ

‘‘ইচ্ছা করলে সিয়াম পালন কর এবং চাইলে ভেঙ্গেও ফেলতে পার।’’ (মুসলিম : ১১২১)

প্রশ্ন ৩০ : সফরে সিয়াম পালন করা উত্তম না ভঙ্গ করা উত্তম।
উত্তর : মুসাফিরের জন্য যেটা সহজ সেটাই উত্তম। সফররত অবস্থায় সিয়াম পালন যদি কষ্টকর হয়ে যায় তাহলে ভেঙ্গে ফেলাই উত্তম। অতি বেশি কষ্টকরে সিয়াম পালন করা ঠিক নয়।

(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না।’’ (বাকারাহ : ১৮৫)

(খ) মাক্কাহ বিজয়ের বৎসর মাক্কার উদ্দেশ্যে কুরা আলগামীম নামক স্থানে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সামনে আসর বাদ সিয়াম ভঙ্গ করে পানি পান করলেন। (মুসলিম : ১১১৪)

(গ) জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সফরে কষ্ট হওয়ার পর ও একদল লোক সিয়াম পালন করেই যাচ্ছে। বিষয়টি জানার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

أُولَئِكَ الْعَصَاةُ أُولَئِكَ الْعَصَاةُ

‘‘তারা পাপী তারা পাপী।’’ (মুসলিম : ১১১৪)


উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সফররত অবস্থায়- অতিমাত্রায় কষ্ট করে সিয়াম পালন করা পরহেজগারীর কাজ নয়, বরং এটা পাপের কাজ।

(ঘ) একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজায়গায় কিছু মানুষের ভীড় দেখে এগিয়ে দেখলেন যে, এক লোককে ছায়া দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেলেন, সে কে? লোকেরা বলল, এ ব্যক্তি রোযাদার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :

لَيْسَ مِنَ الْبِرِّ اَلصِّيَامُ فِي السَّفَرِ

‘‘সফরে সিয়াম পালন করা ভালকাজ নয়। (বুখারী : ১৯৪৬; মুসলিম : ১১১৫)

এসব দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, সফর কষ্টকর হলে রোযা না রাখাই শ্রেয়। আর ভ্রমণ যদি খুব বেশি কষ্টের না হয় তাহলে সিয়াম পালন করাই উত্তম।


১৫শ অধ্যায়
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের সিয়াম


প্রশ্ন ৩১ : গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীরা কি সিয়াম পালন করবে নাকি ভঙ্গ করবে?

উত্তর : গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীণী সিয়াম পালন করলে নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় তাদের সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েজ আছে এবং পরে তা কাযা করে নেবে। পরে করলে তারা সিয়াম পালনও করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

إِنَّ اللهَ تَعَالَى وَضَعَ عَنْ الْمُسَافِرِ الصَّوْمَ وَشَطْرَ الصَّلاَةِ وَعَنْ الْحَامِلِ أَوْ الْمُرْضِعِ الصَّوْمَ أَوْ الصِّيَامَ

‘‘আল্লাহ রববুল ‘আলামীন মুসাফিরদের সালাত অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের সিয়াম না রেখে পরে আদায় করার অবকাশ দিয়েছেন। (তিরমিযী : ৭১৫)
তাদের বিষয়টি সাধারণ রোগী ও মুসাফিরের সিয়ামের মাসআলার অনুরূপ।


প্রশ্ন ৩২ : ফিদইয়ার পরিমাণ কত?
উত্তর : এক মুদ (৫১০ গ্রাম) পরিমাণ গম।

تُفْطِرُ وَتُطْعِمُ مَكَانَ كُلِّ يَوْمٍ مِسْكِيْنًا مُدًّا مِنْ حِنْطَةٍ

অর্থাৎ প্রতি একদিনের রোযার বদলে একজন মিসকীনকে এক মুদ (৫১০ গ্রাম) পরিমাণ গম (ভাল খাবার) প্রদান করবে। (বাইহাকী : ৪/৩৮৯)


প্রশ্ন ৩৩ : হায়েয ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়ার পর সালাত, রোযা কীভাবে কাযা করবে?
উত্তর : সালাত কাযা করতে হবে না। তবে এ কারণে যতটা রোযা ভাঙ্গা গেছে ঠিক ততটা রোযাই আবার কাযা করতে হবে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন :

فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلاَ نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلاَةِ

‘‘সিয়াম কাযা করতে আমাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সালাত কাযা করতে আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় নি।’’ (মুসিলম : ৩৩৫)


প্রশ্ন ৩৩ : হায়েয ও নিফাসওয়ালী মহিলা কীভাবে বুঝবে যে সে ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়ে গেছে?
উত্তর : যখন দেখবে যে তার ঋতুস্রাব সাদা রঙে পরিণত হয়ে গেছে, তখন বুঝবে সে পাক হয়ে গেছে।

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন :

لاَ تَعْجَلْنَ حَتَّى تَرَيِنَّ الْقِصَّةَ الْبَيْضَاءَ

‘‘তোমরা তাড়াহুড়া করে হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে মনে করো না। যতক্ষণ না শুভ্র পানি দেখতে পাও।’’ (বুখারী : ৩১৯)