Sunday, May 31, 2015

হাদিসের আলোকে শবে বরাতের প্রমান (পর্ব ৪) :-


★★★ দশম হাদীছ( اسناده ضعيف )

উছমান ইবনু আবিল আস নবী করীম (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ যখন শা’বান মাসের পনের তারিখ রাত আগমণ করে তখন জনৈক আহবানকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান করতে থাকেন যে, আছো কি কোন ক্ষমার ভিখারী তাকে আমি ক্ষমা করে দিবো? আছো কি কোন যাচনাকারী যাকে আমি দান করবো? অতঃপর যে কেউ চায় আল্লাহ তাআলা তাকে তাই দান করেন। কিন্তু ব্যভিচারিনী এবং মুশরিক ছাড়া।

উক্ত হাদীছটি ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

উক্ত হাদীছের সনদ সম্পর্কে পর্যালোচনাঃ

১। উক্ত হাদীছটি ইমাম বাইহাকী আলী ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু বিশর থেকে বর্ণনা করেন।

যার সম্পর্কে খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ

“ তিনি সত্যবাদী, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ”

( তারীখে বাগদাদঃ খ-১২, পৃ-৯৯ )

২। আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনু আমর আর রাযযায (মৃঃ ৩৩৯ হিঃ)

যার সম্পর্কে হাকেম বলেনঃ

“ তিনি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। ”

( সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-১৫, পৃ-৩৮৬ )

খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ

“ তিনি নির্ভরযোগ্য ও আস্থাযোগ্য ছিলেন। ”

( তারীখে বাগদাদঃ খ-৩, পৃ-১৩২ )

৩। মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আর রিয়াহী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)

যাঁর সম্পর্কে ইমাম দারা কুতনী বলেনঃ

“ তিনি সত্যবাদী। ”

খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ

“ আমি তাঁর সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু আহমদকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি বলেছেনঃ মুহাম্মদ সত্যবাদী। ”

( তারীখে বাগদাদঃ খ-১, পৃ-৩৭২ )

৪। জামি ইবনুস সবীহ আর রমলী

হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ

“ তাঁর সম্পর্কে আব্দুল গণী ইবনু সাঈদ মুশতাবিহ এর মধ্যে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন তিনি একজন দুর্বল রাবী। এবং ইবনে আবী হাতিম স্বীয় গ্রন্থ আল জরহি ওয়াততাদীলে যাকে উল্লেখ করে কোন আলোচনা ও সমালোচনা করেন নি এবং বলেছেন যে তাঁর থেকে ইমাম আবু যুরআ ও ইবনে মাঈন হাদীছ গ্রহণ করেছেন। ”

( খ-১, পৃ-৫৩০ )

( উল্লেখ্য যে, ইবনু আবী হাতীম কারো ব্যাপারে চুপ থাকলে ঐ রাবী নির্ভরযোগ্য বলে সাব্যস্ত হয়। )

৫। মারহূম ইবনু আবদিল আজীজ

হাফিয ইবনু হাজার তার সম্পর্কে বলেছেনঃ

“ তিনি অষ্টম স্তরের একজন নির্ভরযোগ্য রাবী। ”

( তাক্বরীবুত তাহযীবঃ খ-২, পৃ-১৬৯ )

ইমাম আহমদ, নাসাঈ, ইবনু মাঈন প্রমুখও তাঁকে ছিক্বাহ বলেছেন। হাফিয যাহাবী, ইবনু হিব্বানও তাঁকে ছিকাহ এর মধ্য থেকে বিবেচনা করেছেন।

৬। দাউদ ইবনু আবদির রহমান আল আততার

তাঁর সম্পর্কে আবু হাতিম বলেছেনঃ

“ তিনি গ্রহণযোগ্য। একজন নেককার ছিলেন। ”

( তাহযীবুল কামালঃ খ-৮, পৃ-৪১৫ )

যাহাবী (রহঃ) বলেনঃ

ثقة তিনি নির্ভরযোগ্য।

ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বর্ণনা করেন যে,

তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন।

হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ

তিনি ছিকাহ রাবী।

৭। হিশাম ইবনু হাসসান আল আযদী

তাঁর সম্পর্কে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্য সমষ্টিগতভাবে নিম্নে পেশ করা হলঃ

হাফিজ ইবনু হাজার, উছমান বিন আবী শায়বা, ইবনে হিব্বান, ইমাম আবু হাতিম, ইবনু মঈন, আল আজালী, ইবনু সাআদ, ইবনু আদী প্রমূখ ইমামদের দৃষ্টিতে তিনি নির্ভরযোগ্য সত্যবাদী বহু হাদীছের বর্ণনাকারী ছিলেন।

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১১, পৃ-৩৩; জরাহ ওয়াত তাদীলঃ খ-৯, পৃ-৫৪ )

তবে ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) তার সম্পর্কে বলেনঃ

“ হিশাম হাসান বসরী এবং আতা থেকে যেসব হাদীছ বর্ণনা করেছেন, সেগুলোর ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণ প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ হিশাম হাদীছের মধ্যে ইরসাল (রাবী এর নাম উল্লেখ না করা) করতেন। তাই মুহাদ্দিছগণ মনে করেন, হিশাম এসব হাদীছ হাওশাব এর কিতাব থেকে নিয়েছেন। (সরাসরি আতা ও হাসান থেকে নেননি।) ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১১, পৃ-৩৫ )

ইবনু আদী বলেনঃ

“ আরআরা বলেনঃ আমাকে জারীর বলেছেনঃ আমি সাত বছর যাবৎ হাসান বসরী (রহঃ) এর দরসে বসেছি। কিন্তু হিশামকে কখনো তাঁর সাথে দেখিনি। আমি (আরআরা) বললামঃ হে আবু নাসর (জারীর)! হিশাম তো আমাদেরকে হাসান বসরী (রহঃ) এর সূত্রে বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আর আমরা হিশাম থেকে বর্ণনা করেছি। সুতরাং আপনার ধারণা মতে হিশাম এসব হাদীছ কার নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন? জারীর প্রতি উত্তরে বললেনঃ আমার ধারণা মতে তিনি হাওশাব থেকে গ্রহণ করেছেন। ”

( সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৬, পৃ-৩৫৫; মীযানুল ইতিদালঃ খ-৪, পৃ-২৯৫ )

পর্যালোচনাঃ

অতএব, ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) এবং আরআরা (রহঃ) কর্তৃক উল্লেখিত বিবরণ দ্বারা বুঝা যায় যে, হিশাম ইবনু হাসসান সরাসরি হাসান বসরী (রহঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেননি। বরং মাঝখানে আরো একজন রাবী আছেন, হিশাম যাঁর নাম তাঁর সনদে উল্লেখ করেন নি। হাদীছ শাস্ত্রের পরিভাষায় এটাকে তাদলীস বলা হয়। আর মুহাদ্দিছীনে কেরামের কাছে সিকাহ (ثقة) রাবী এর তাদলীছ গ্রহণযোগ্য।

যথা তাদরীবুর রাবী ও কাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছ গ্রন্থে এ নীতিমালা উদ্ধৃত হয়েছে যে,

“ বাযযার এর ভাষ্যমতে ছিকাহ রাবীগণের মধ্য থেকে কেউ তাদলীস করলে তাঁর তাদলীস উলামাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। ”

( তাদরীবুর রাবীঃ খ-১, পৃ-২২৯; ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছঃ পৃ-১৫৯ )

৮। হাসান ইবনু আবিল হাসান আল বাসরী

তিনি একজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ।

হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ

তিনি হযরত আলী (রঃ), হযরত তালহা (রঃ) এবং হযরত আয়শা (রঃ) এর সাক্ষাত লাভ করেছেন। সওবান (রঃ), আম্মার ইবনে ইয়াসির (রঃ), উসমান ইবনু আবিল আস (রঃ) এবং মা’কাল ইবনু সিনান (রঃ) প্রমূখ থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের থেকে শ্রবণের মর্যাদা লাভ করেন নি।

আজলী তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ হাদীছ বিশারদগণের মন্তব্য এরকমঃ

“ আল আদাভী বলেন, সকলেই এই শায়খ অর্থাৎ হাসানের নিকট যাও, হাদীছ গ্রহণ কর, তিনি সবচেয়ে বড় আলেম। তিনি বসরাবাসীদের শায়খ (ইমাম), তিনি তাবেঈ, নির্ভরযোগ্য বুজুর্গ, হাদীছের বাহক। ”

( জরাহ ওয়াত তাদীলঃ খ- ৩, পৃ-৪০; তাবকাত; তাহযীবুত তাহযীব )

এসব দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি কত বড় আলেম ও ছিক্বাহ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিছ।

তবে তাঁর ব্যাপারে দুটি মন্তব্য ব্যতিক্রম যা নিম্নে পেশ করা হলোঃ

১। বাযযার তাঁর মুসনাদে এ বলেনঃ

“ হাসান বসরী তিনি ইবনু আব্বাস, আসওয়াদ, উবাদা এবং উছমান থেকে শ্রবণমর্যাদা লাভ করেন নি। ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-২, পৃ-২৩৫ )

২। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ

“ হাসান বসরী একজন ছিক্বাহ রাবী, প্রসিদ্ধ ফক্বীহ। তিনি ইরসাল ও তাদলীস করতেন। ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১, পৃ-২০২ )

পর্যালোচনাঃ

বাযযার এবং হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) এর উক্ত মন্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, ইমাম হাসান বসরী (রহঃ) উছমান উবনু আবিল আস থেকে হাদীছটি সরাসরি বর্ণনা করেন নি। বরং তিনি তাদলীস করেছেন। তবে হাসান বসরী (রহঃ) যেহেতু একজন নির্ভরযোগ্য হাদীছ বর্ণনাকারী, ফিক্বহ-হাদীছের ইমাম এবং একজন সুপ্রসিদ্ধ তাবিঈ, তাই তাঁর কৃত তাদলীস গ্রহণযোগ্য হবে। হাদীছটির প্রমাণে কোন অন্তরায় হবে না তা তাদরীব ও কাওয়ায়েদ ফী উলূমিল হাদীছ-এ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

৯। উছমান আবিল আস আস সাক্বাফী

তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। হযরত মুআবিয়া (রঃ) এর খেলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

হাদীছটির অবস্থানঃ

উল্লেখিত বিবরণ দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত হাদীছটির সনদে জামী ইবনুস সাবীহ আর রামালী ব্যতীত সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য ও আস্থাযোগ্য। হাদীছটির সনদের মাত্র একজন রাবী আছেন, যিনি বিতর্কিত হেতু কেউ কেউ যঈফ বলেছেন। ইবনু আবি হাতিম চুপ থেকে তার নির্ভরযোগ্যতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই হাদীছের সমর্থনেও যেহেতু আরো হাদীছ বিদ্যমান, বিধায় হাদীছটি উন্নীত হয়ে হাসান স্তরে পৌছে যায়। একারণেই শুয়াবুল ঈমানের মুহাক্কিক আদনান আব্দুর রহমান اسناده حسن বলে সূত্রের দিক থেকে হাদীছটিকে হাসান বলে রায় প্রদান করেছেন।

( দেখুন শুয়াবুল ঈমানঃ খঃ ৩, পৃ – ৩৮৩ )

তবে শুআবুল ঈমানে মুহাক্কিক শাইখ যাগলুল এর মন্তব্য হলোঃ

“ হাদীছটির সনদ দুর্বল। হাসান বসরী তাবেঈ এর সাক্ষাত উসমান বিন আবিল আস (রঃ) সাহাবীর সাথে হয়নি, (মাঝখানে রাবীর উল্লেখ নেই।) ”

( হাশিয়াহ শুয়াবুল ঈমান )

এ ব্যাপারে تدريب الراوى এবং قواعد فى علوم الحديث এর উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রমাণ হয় যে, হাসান বসরীর মত বিখ্যাত তাবেঈ ও মুহাদ্দিছ এর এধরণের তাদলীস সূত্র বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অন্তরায় নয় বরং তা সকল উলামার নিকট গ্রহণযোগ্য বিধায় এ হাদীছকে হাসান বা সহীহ বলে যে মন্তব্য আদনান আব্দুর রহমান করেছেন তা যথাযথ এবং সঠিক বলে সাব্যস্ত।





★★★ একাদশ হাদীছ( اسناده ضعيف لكن ليس فيه كذاب )

হযরত আলী ইবনু আবি তালিব (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ শা’বান মাসের পনের তারিখ রাত আসলে তখন তার রাতের অংশে ইবাদত করো এবং দিনের অংশে রোজা রাখো। কারণ ওই রাতে সূর্যাস্ত যাওয়ার পর মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন, আছো কি কোন মাগফিরাতের প্রত্যাশী? তাকে আমি মাগফিরাত দান করবো। আছো কি কোন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি তাকে আমি সুস্থতা দান করবো। আছো কি অমুক আছো কি অমুক - এভাবে প্রভাতের সূচনা পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।

উক্ত হাদীছটি

১। ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে
২। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৩। মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীবে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

উক্ত হাদীছের সনদ পর্যালোচনাঃ

হাদীছটির সনদে নিম্নোক্ত রাবীগণ রয়েছেনঃ

১। হাসান ইবনু আলী আল খিলাল (মৃঃ ২৪২ হিঃ)

ইমাম নাসাঈ (রহঃ) ব্যতীত সিহাহ সিত্তাহর প্রত্যেকেই তাঁর থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন।

খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ ثقة حافظ , তিনি নির্ভরযোগ্য এবং হাফিযুল হাদীছ ছিলেন।

ইয়াকুব ইবনু শাইবাহ বলেনঃ তিনি নির্ভরযোগ্য ও আস্থাযোগ্য রাবী।

ইবনু হিব্বান তাঁকে নির্ভরযোগ্যদের মধ্যে পরিগণিত করেছেন।

হাফিয ইবনু হাজারও তাঁকে নির্ভরযোগ্য এবং হাফিযুল হাদীছ সাব্যস্ত করেছেন।

২। আব্দুর রাজ্জাক ইবনু হুমাম ইবনু নাফি (মৃঃ ২১১ হিঃ)

আসহাবে সিত্তাহর প্রত্যেকেই তাঁর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন।

তিনি ইবনু জুরাই আওযায়ী, মালিক, সুফিয়ান সওরী প্রমূখের ন্যায় বড় বড় ইমামদের শাগরিদ।

আলী ইবনুল মাদীনী থেকে কথিত আছে যে, হিশাম ইবনু ইউসুফ বলেছেন, আব্দুর রাজ্জাক আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম এবং হাফিযে হাদীছ।

আহমদ ইবনু হাম্বল থেকে বর্ণিত যে, তিনি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীছ বর্ণনাকারী ছিলেন।

৩। ইবনু আবি সাবুরাহ (মৃঃ ১৬২ হিঃ)

তাঁর সম্পর্কে পরে উল্লেখ করা হচ্ছে।

৪। ইবরাহীম ইবনু মুহাম্মদ।

ইমাম বুখারী আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে এবং ইমাম যাহাবী মীজানুল ইতিদাল গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উভয়ের কেউই তাঁকে দুর্বল বলেন নি।

হাফিয ইবনু হাজার তাঁর ব্যাপারে বলেনঃ

صدوق من السادسة

“ তিনি ষষ্ঠ স্তরের একজন সৎ রাবী। ”

( তাক্বরীবুত তাহযীবঃ খ-১, পৃ-৬৫; তাহযীবুল কামালঃ খ-২, পৃ-১৯৩ )

ইবনে হিব্বান তাকে কিতাবুছছিক্বাতে উল্লেখ করে নির্ভরযোগ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন।

( দেখুনঃ كتاب اثقات পৃ – ১৯, খ – ১ )

৫। মুআবিয়া ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু জাফর।

ইমাম নাসাঈ এবং ইবনু মাজাহ তাঁর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন।

হাফিয আজালী তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন।

ইবনু হিব্বানও তাঁকে নির্ভরযোগ্যদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।

হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ তিনি চতু্র্থ স্তরের একজন গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী।

হাফিয যাহাবী বলেনঃ “ ثقة ” নির্ভরযোগ্য।

( দেখুনঃ আল কাশেফ – ২/২৭৬ )

৬। আব্দুল্লাহ ইবনু জা’ফর।

আল ইসাবা ফী তাময়িযিস সাহাবা গ্রন্থে ( ২য় খন্ড পৃঃ ২৮৯ ) রয়েছে যে, তিনি নবী করীম (সঃ) এর সাহাবা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি সাধারণ স্তরের সাহাবাদের মধ্যে পরিগণিত। ইতিহাসের কিতাবসমূহে তাঁর অনেক ফযীলত ও গুণাগুণ উল্লেখ রয়েছে।

৭। আলী ইবনু আবি তালিব (রঃ)।

একজন জলীলুল ক্বদর সাহাবী, খুলাফায়ে রাশেদীনের একজন।

রাবী ইবনু আবি সাবুরাহ (মৃঃ ১৬২ হিঃ) সম্পর্কে অস্পষ্ট সমালোচনাঃ

ইমাম নাসাঈ বলেনঃ তাঁর বর্ণিত হাদীছ মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য।

আব্দুল্লাহ এবং সালিহ স্বীয় পিতা ইমাম আহমদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি হাদীছ জাল করতেন।

তবে একথাগুলো অতিশয়োক্তি থেকে মুক্ত নয়, কারণ হাদীছ শাস্ত্রবিদদের নিকট সর্বজনবিদিত একটি মূলনীতি এও আছে যে, একজন বর্ণনাকারী দোষ-ত্রুটির কারণ ও বিবরণ উল্লেখ ব্যতীত কেবল দোষ ত্রুটি বর্ণনা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। উপরন্তু উক্ত কারণ ও বিবরণ এর উপর প্রমাণও থাকতে হবে।

( দেখুনঃ الرفع والتكميل পৃ-৪১ )


★★★ প্রাসংগিক অন্যন্য আলোচনা :-

এখানে জরাহ-তা'দীল' শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি সম্পর্কে সবার অবগত হওয়া দরকার।

জরাহ এবং তা'দীল প্রত্যেকটি মূলত দুই প্রকার। জরহে মুবহাম (অস্পষ্ট সমালোচনা), জরহে মুফাসসার (ব্যাপক বিস্তৃত সমালোচনা), তা'দীলে মুবহাম (অস্পষ্ট স্বীকৃতি), তা'দীলে মুফাসসার (বিশদ সত্যয়ন ও স্বীকৃতি)।



মুবহাম বলতে সেই সব জরাহ-তা'দীলকে বুঝায় যেগুলোতে জরাহ-তা'দীলের কারণসমূহ বিবৃত হয়নি। পক্ষান্তরে যেখানে জরাহ-তা'দীলের কারণসমূহ বিশদভাবে বিবৃত হয়ে থাকে, তাকে মুফাসসার বলা হয়। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম সহ জরাহ তা'দীলের অধিকাংশ বিদগ্ধ ইমামগণের মতে, তা'দীলে মুবহামও গ্রহণযোগ্য। এতে এর কারণগুলো উল্লেখ করার কোন আবশ্যকতা নেই। পক্ষান্তরে জরাহ যদি মুবহাম হয়, তার কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। এক্ষেত্রে সমালোচনার কারণ সমূহ উল্লেখ থাকা একান্ত আবশ্যক। খতীব বাগদাদী, হাফেজ ইবনুস সালাহ ও ইমাম নববী এই মতকে অন্যান্য মতামত থেকে অত্যধিক সঠিক ও সমধিক প্রসিদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন এবং একে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামগণের মতামত বলে উল্লেখ করেন।

( বিস্তারিত জানতে দেখুন - আল কিফায়াহ ফী উলূমির রেওয়ায়েহঃ পৃ-১০০, ১০৮, ১০৯; মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস সালাহঃ পৃ-১১৭; আত তাকরীবঃ পৃ-২০২ )

অর্থাৎ যখন কোন রাবী বা ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা করা হবে, তখন তা বিস্তারিত আকারে প্রমাণ সহকারে কারণ সহ উল্লেখ থাকতে হবে, নতুবা তা মুহাদ্দিসীনে কেরামের কাছে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

আলী ইবনে আল মাদীনী এবং ইমাম নাসাঈ, যারা দুজনেই ইবনে আবি সবুরাহর কিছু শতক পরে এসেছেন, তারা বলেন যে, ইবনে আবি সবুরাহ "মাতরুকুল হাদীস" ছিলেন (যাঁর হাদীস বর্ণনা করা যাবে না, কারণ তিনি ঐটুকু যোগ্যতা রাখেন না।)

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এর পুত্র, আব্দুল্লাহ এবং সালিহ স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি হাদীস জাল করতেন।

ইবনে আদীও ইবনে আবি সবুরাহকে হাদীস জালকারী ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করেছেন।

কিন্তু, এ সমস্ত বক্তব্য তাদের নয় যারা ইবনে আবি সবুরাহ এর সমসাময়িক বড় বড় জ্ঞানী লোক ছিলেন, বরং তাদের মত যারা ইবনে আবি সবুরাহর অনেক যুগ পরে এসেছেন। তাছাড়া এই মতগুলো অতিরঞ্জিত বা অতিশয়োক্তি থেকেও মুক্ত নয়। কারণ এসব মুহাদ্দিসীনের কেউই তার দোষ ত্রুটির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে যান নি এবং কোন প্রমাণও দিয়ে যান নি।

এমনকি, ইমাম বুখারী, উলূমিল হাদীস শাস্ত্রে তার সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং গভীর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও, ইবনে আবি সবুরাহ সম্পর্কে কোন ধরণের ব্যাখ্যা ছাড়াই সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি ইবনে আবি সবুরাহকে শুধুমাত্র যঈফ বলে উল্লেখ করেছেন। এটা তাই আরও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এটা হতে পারে যে, ইবনে আবি সবুরাহ কিছুটা দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, যার ফলে তিনি ইমাম বুখারীর কাছে রাবীর যোগ্যতার যে মানদণ্ড আছে, সেটা পূর্ণ করতে পারেন নি। তাই, তাঁর এ মতটি রাবীর পদমর্যাদা এবং ন্যায়পরায়ণতা বা পূর্ণতার ক্ষেত্রে নয়; বরং ইমাম বুখারীর নিজের কঠোর মানদণ্ড অনুযায়ী রাবীর যে যোগ্যতা দরকার ছিল, শুধুমাত্র তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ইমাম যাহাবী এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেছেন।

যাই হোক না কেন, এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝে রাখা দরকার যে, হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী, একজন জাল হাদীস বানানো ব্যক্তি বা রাবী কখনই 'যঈফ' রাবীর তালিকাভুক্ত হতে পারে না।

ইমাম বাযযার এই হাদীসকে "লীন হাদীস" বলে যে মন্তব্য প্রদান করেছেন, তাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়।

হাদীস তালিকাভুক্ত (কোন হাদীস কোন তালিকায় পড়বে) করার ক্ষেত্রে, হাদীস শাস্ত্রে "লীন হাদীস" এবং "ইয়াদা উল হাদীস" এই ২ টি গ্রুপের মাঝে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান।

( দেখুনঃ কাশফুল আসতার আন জাওয়াইদিল বাযযার )

কোন ভাবেই এই দাবী করা সঠিক হবে না যে, ইবনে আবি সবুরাহ জাল হাদীস রচনাকারী ছিলেন। যদি তাই হত, তাহলে ইমাম মালিক এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রসিদ্ধ ফকীহর উপস্থিতিতে ইবনে আবি সবুরাহকে কখনোই মদীনা মুনাওয়ারাতে ইফতা তথা কাযীর পদের দায়িত্ব ও সুবিধা দেয়া হত না, এক কথায় সম্ভবও নয়।

ঠিক একই ভাবে, ইমাম মালিকের পক্ষে এটাও কখনও সম্ভব হত না যে, ঐ সময়ের পবিত্র নগরীর ৩ জন বুজুর্গ এবং প্রসিদ্ধ স্বীকৃত ব্যক্তির একজন হিসেবে তিনি ইবনে আবি সবুরাহর নাম উল্লেখ এবং প্রস্তাব করেছিলেন। খলিফা মনসুর যখন মদীনা মুনাওয়ারাতে কাযী পদের জন্য লোক খুঁজছিলেন, তখন ইমাম মালিক এই প্রস্তাব করেছিলেন অন্য ২ জনের সাথে ইবনু আবি সবুরাহকে কাযী পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য।

( দেখুনঃ সিয়ারু আলামিন নুবালা এবং তাহযীবুত তাহযীব; আরও দেখতে পারেনঃ মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানীর কিতাব লাইলাতুল বারাআত )

তাছাড়াও, আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইবনে আদী বাদে, অন্য কোন মুহাদ্দিসীন তাদের আগে ইবনে আবি সবুরাহর সত্যবাদীতা বা মর্যাদার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেন নি। শুধুমাত্র ইমাম বুখারীর মন্তব্য পাওয়া যায় এবং তাঁর কঠোর মূলনীতি ও মানদণ্ডের আলোকে তিনি শুধুমাত্র এই মন্তব্যটিই করেছেন যে, ইবনে আবি সবুরাহ যঈফ। (হাদীসের মতন সম্পর্কেও কিছু বলা হয় নি)।

ইমাম আবু দাউদ বলেন, সে (ইবনে আবি সবুরাহ) আহলুল মদীনার (মদীনার মানূষ) কাছে গ্রহণযোগ্য মুফতি ছিলেন।

হযরত মা'আন উল্লেখ করেন যে, আমিরুল মুমিনীন আবু জাফর আল মনসুর ইমাম মালিকের কাছে জানতে
চান,

" বড় বড় প্রসিদ্ধ মাশায়েখদের মধ্যে এখন কারা কারা বেঁচে আছেন? " তিনি (সাহিবুল মুতহুব) তাদের নাম পরপর উল্লেখ করে উত্তর দেন, বলেনঃ " ইবনে আবি তাঈব, ইবনে আবি সবুরাহ এবং ইবনে আবি সুলামাহ আল মাজিশুন বেঁচে আছেন এখন। "

এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, মদীনা মুনাওয়ারাহ ইসলাম এবং খাইরুল কুরুনের জমানার মুসলিমদের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। ইবনে আবি সবুরাহ প্রথমে ইরাকের একজন মুফতী এবং কাযী ছিলেন। এটা ছিল ইমাম আবু ইউসুফের নিয়োগের আগের কথা। অতঃপর, তাঁকে মদীনা মুনাওয়ারাহর মুফতী এবং কাযী পদের সুবিধা (নিয়োগ) দেওয়া হয়।

এরকম একজন প্রসিদ্ধ, নামকরা, গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি কি কখনো সাদিক এবং আদিল ( সত্যবাদী এবং নির্ভরযোগ্য ) না হয়ে পারে ??
তিনি কি হাদীস জাল কারী হতে পারেন এবং রসূলুল্লাহ (সঃ) এর উপর মিথ্যা আরোপ করতে পারেন ??


ইবনে আবি সবুরাহ হযরত আলী (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের নিছক একজন রাবী মাত্র। তাছাড়া, এই মন্তব্যগুলো আলী (রঃ) এর হাদীসের মতন (বক্তব্য) এর উপর করা হয় নি। "যঈফ" শুধুমাত্র ইবনে আবি সবুরাহকেই বলা হয়েছে।

ইবনে আবি সবুরাহ প্রসিদ্ধ, বুজুর্গ, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যেমনঃ হযরত আতা ইবনে আবি রুবাহ, ইমাম আরুজ এবং হিশাম ইবনে আবি ওরওয়াহ প্রভৃতি বুজুর্গদের ছাত্র ছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন।

তাছাড়াও, ইবনে আবি সবুরাহ, বিখ্যাত মুহাদ্দিস এবং হাদীসের উস্তাদ ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ইবনুল হুইমাম এর উস্তাদ ছিলেন। আবার ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন ইমাম বুখারীর উস্তাদ। পাশাপাশি ইমাম ইবনে জুওরাযী, ইমাম আবু আসিয়াম আন নাবিলেরও উস্তাদ ছিলেন।

( আরও দেখুনঃ তাহযীবুল কামাল )

যাই হোক না কেন, যারা ইবনু আবি সবুরাহকে "জাল হাদীস রচনাকারী বা যঈফ" বলেছেন, তাদের মধ্যে কেউই এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে যাননি, কিংবা কোন স্পষ্ট দলীল বা প্রমাণও দিয়ে যান নি। এমনকি আমাদের জ্ঞানের আওতায় ঐসব মুহাদ্দিসীনগণ ইবনে আবি সবুরাহ কর্তৃক সম্পৃক্ত এমন কোন হাদীসকেও মওযু (জাল) বলেন নি।

অথচ ইবনে আদী, ইবনে আবি সবুরাহর অনেক হাদীস নিয়েই আলোচনা করেছেন, কিন্তু তার একটি হাদিসও তিনি মওযু বলে চিহ্নিত করেন নি, কিংবা তার ঐসব কিতাব যেখানে তিনি মওযু হাদীসগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেখানেও স্থান পায়নি। বাস্তব সত্য হল, ইবনে আদী যেসব হাদীস নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার প্রত্যেকটি হাদীসই অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবীদের কাছ থেকেও বর্ণিত। যার ফলে, সেসব হাদীসগুলোও প্রসিদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য রাবীদের কাছ থেকেই বর্ণিত। আর ইবনে আদী নিজেই ইবনে আবি সবুরাহর অনেক হাদীস নিয়ে আলোচনা করেছেন।

মুফতী তকী উসমানী লিখেছেনঃ হযরত আলী (রঃ) এর হাদীসটি সিহাহ সিত্তার একটি বিখ্যাত কিতাব সুনানে ইবনে মাজাহতে উল্লেখ আছে এবং ইমাম বায়হাকীর বিখ্যাত কিতাব শুয়াবুল ঈমানেও উল্লেখ আছে। তাদের উভয়েই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এর বিশুদ্ধতা নিয়ে কোন মন্তব্য করেন নি।

ইবনে আবি সবুরাহ নামক একজন রাবী থাকায় হাদিসের স্কলাররা তথা মুহাদ্দিসীনগণ এই হাদীসকে দুর্বল বা যঈফ বলেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তিনি হাদীস জাল করতেন, তা সঠিক নয়। বাস্তব সত্য কথা হচ্ছে, তিনি মদীনার মুফতী ছিলেন; মনসুরের আমলে ইরাকের কাযী (বিচারক) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি ইমাম আবু ইউসুফের সাথে অত্যন্ত সফলও ছিলেন। তিনি ইমাম মালিকের সহযোগী ছিলেন।

একদা মনসুর, আব্বাসী খলিফা, ইমাম মালিকের কাছে ৩ জনের নাম জিজ্জেস করেন, ইমাম মালিক তার মধ্যে একজনের নাম বলেন ইবনে আবি সবুরাহ। তিনি যদি সত্যিকার অর্থেই হাদীস জালকারী হতেন, তাহলে ইমাম মালিক কখনোই তার নাম বলতেন না। তবে তার উচ্চ পদমর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তার স্মৃতিশক্তি কিছুটা কম থাকায়, অনেক ইমামগণ যেমন ইমাম বুখারী তার কিছুটা সমালোচনা করেছেন এবং তাকে যঈফ বলেছেন; কিন্তু তাকে জাল হাদীস রচনাকারি কিংবা মিথ্যুক ঘোষণা করেন নি।

ইমাম আহমদ তাকে মিথ্যুক ও হাদীস জালকারী বলেছেন। কিন্তু তার এই মন্তব্য একজনকে হাদীস জালকারী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণঃ

প্রথমত, ইমাম আহমদ ইবনে আবি সবুরাহর অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইবনে আবি সবুরাহর সমসাময়িক কোন বুজুর্গ বা মুহাদ্দিস তার সম্পর্কে এ মত পোষণ করেন নি।

আর দ্বিতীয়ত, যে আরবী শব্দটি ইমাম আহমদ ব্যবহার করেছেন, তা মাঝে মাঝে এক রেওয়ায়েতের সাথে আরেক রেওয়ায়েতের মাঝে অসমাঞ্জস্যতা বা বিশৃংখলা (confusion) ইত্যাদি বুঝাতে ব্যবহৃত হয়, কাউকে মিথ্যাবাদী বা হাদীস জালকারী সাব্যস্ত করার জন্য নয়।
এই কারণে অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনগণ আবু বকর ইবনে আবি সবুরাহকে দুর্বল রাবী হিসেবে সনাক্ত করেছেন, হাদীস জালকারী হিসেবে নয়।

পূর্ব যুগের মুহাদ্দিসীনদের মওযু হাদীস নিয়ে বিশাল বিশাল অনেক কিতাবই রয়েছে, কিন্তু এই হাদীসটি সেসব কিতাবের কোনটিতেই স্থান পায়নি।

এমনকি এটা সবার জানা কথা যে, ইবনে মাজাহ নিজেই প্রায় ২০ টি হাদীসকে মওযু বা জাল হিসেবে সনাক্ত করেছেন। এই হাদীসের তালিকাগুলো এখনও বিদ্যমান, কিন্তু সেখানেও ইবনে মাজাহ তার সুনানে উল্লেখিত এই হাদীসটিকে স্থান দেন নি। অতএব, এই হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা এই যে, হাদীসটি মওযু বা জাল নয়, শুধুমাত্র দুর্বল।

মোদ্দা কথা হল, যারা ইবনু আবি সবুরাহকে জাল হাদীস রচনাকারী বলেছেন তারা কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। الرفع والتكميل পৃ-৪১ কিতাবে কথাটি এভাবে বলা হয়েছেঃ

“ ইবনু আবি সবুরাহ মাতরূকুল হাদীছ কিংবা জাল হাদীছ রচনাকারী হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিছীনে কেরামের কেউই বিস্তারিত কারণসহ বিবরণ দেন নি। ”

তাছাড়া হাফিয যাহাবী তাঁর জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে এভাবে শুরু করেনঃ মহান ফক্বীহ, ইরাকের কাজী, আবু বকর ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবি সাবুরাহ।

ইমাম আবু দাউদ বলেনঃ তিনি মদীনাবাসীর মুফতী ছিলেন।(المدينة مفتى)

ইমাম বুখারী (রহঃ) তাকে যঈফ ছাড়া অধিক কিছু বলেন নি।

হাফিয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী বলেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল বিধায় তিনি হাদীছশাস্ত্রে দুর্বল। মূলত এটাই বিশুদ্ধ এবং চূড়ান্ত রায়।



হাদীছটির অবস্থানঃ

উল্লেখিত বিবরণ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত হাদীছটিতে “ ابن أبى سبره ” ইবনু আবি সবুরাহ নামে জনৈক রাবী ব্যতীত অন্যান্য সকল রাবী নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত। সুতরাং হাদীছটিকে বড় জোর যঈফ বলা যেতে পারে। কোন কোন মুহাদ্দিছ ইবনু আবি সবুরাহকে জাল হাদীছ রচনাকারী বলেছেন বিধায় হাদীছটিকে জাল বলা যাবে না। কারণ তিনি জাল হাদীছ রচনাকারী – কথাটি সঠিক নয়। তাঁর সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও চূড়ান্ত রায় সেটাই যা হাফিয যাহাবী সূত্রে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, স্মৃতি শক্তির দুর্বলতার কারণে তিনি যঈফ রাবী ছিলেন।

এই কারণেই ইমাম যুরকানী হাদীছটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, যদিও তার সনদ দুর্বল কিন্তু তার রাবীগণ মিথ্যুক নন, কিংবা জাল রচনাকারী নন। সর্বোপরি তার সমর্থনে আরো হাদিছ পাওয়া যায় বিধায় হাদীছটির ভিত্তি রয়েছে।

যেমন শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুনিয়া (৭/৩১২) তে এসেছেঃ

সুনানে ইবনু মাজাতে আলী (রঃ) থেকে মারুফ হিসেবে যঈফ সনদ দ্বারা হাদীছটি উল্লেখ হয়েছে। তেমনিভাবে আল মুনযিরী ও হাফিয আল ইরাকী তাঁর দুর্বলতার কারণ উল্লেখ করতঃ নিশ্চয়তার সাথে বলেছেন। কিন্তু হাদীছটির মধ্যে কোন মিথ্যুক ও জাল হাদীছ রচনাকারী নেই এবং তার সমর্থনে আরো হাদীছ আছে যা তার ভিত্তি আছে বলে প্রমাণ করে।

অনুরূপ ভাবে আল্লামা ইরাকীও হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেন ঠিক কিন্তু জাল বলেন নি। তাঁর ভাষায়ঃ

“ শবে বরাতের ফজীলত ও আমল সম্পর্কীয় যে হাদীছ আলী (রঃ) সূত্রে ইবনু মাজাহতে রয়েছে তার সনদ দুর্বল। ”

মোট কথা, হাদীছটি একজন রাবীর কারণে দুর্বল তবে তার ভিত্তি রয়েছে অন্যান্য হাদীছের সমর্থন পাওয়া যাওয়ায় তার উপর আমল করা যাবে।

সার কথাঃ

ইবনু আবি সবারাহ নামক একজন রাবী থাকায় আহলে হাদীস/সালাফীদের কিছু আলেম হযরত আলী (রঃ) এর এই হাদীসটিকে জাল বলার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু কথাটি সঠিক নয়। হাদীসটি শুধুমাত্র দুর্বল। এ কারণেই আল্লামা ইরাকী, ইমাম আল মুনযিরী, ইমাম যুরকানীর মত বিজ্ঞ মুহাদ্দিসরা এই হাদীসটি জাল বলেন নি, শুধুমাত্র দুর্বল বলেছেন। অনেক বড় বড় বুজুর্গরা এই হাদীসটি তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং এর উপর আমল করা যাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। যেহেতু হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী কোন রাবীর সমালোচনা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য শুধুমাত্র দুর্বল বা মিথ্যক, এতটুকু উল্লেখ থাকলেই হয় না, বরং এর স্বপক্ষে কারণসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ দলীল-প্রামাণাদি থাকা আবশ্যক, সেহেতু যারা এই রাবীকে মিথ্যুক বা জাল হাদীস রচনাকারী বলে থাকেন, তারা দয়া করে প্রমাণ দেখিয়ে যাবেন কেন তিনি মিথ্যুক বা জাল হাদীস রচনাকারী।




★★★ দ্বাদশ হাদীছ(حديث ضعيف)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, পাঁচটি রাত এমন আছে যে রাতগুলোতে দু'আ ফেরত দেয়া হয় না। জুমআর রাত, রজবের প্রথম রাত, শাবানের পনের তারিখ এর রাত এবং দু'ঈদের রাতে।

উক্ত হাদিছটি

১। হাফেয আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মুসনাদে
২। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে

░▒▓█► হাদীসটির মান : দুর্বল

সুতরাং সনদের দিক দিয়ে হাদীছটি দুর্বল হলেও ফাযায়েলের ক্ষেত্রে এরূপ হাদীছ গ্রহণযোগ্য। এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই।

রাবী পর্যালোচনা ও হাদীছটির অবস্থানঃ

হাফিয আব্দুর রাজ্জাক উক্ত হাদীছটি একজন অজ্ঞাত উস্তাদ থেকে তিনি ইবনুল বীলমানী এবং তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন।

১। তাঁর সরাসরি উস্তাদ অজ্ঞাত, অপরিচিত।

ইবনু বীলমানী এবং তাঁর পিতা সম্পর্কে মুহাদ্দিছদের মন্তব্য নিম্নে প্রদত্ত হলো।

২। মুহাম্মদ ইবনু আবদির রহমান আল বীলমানী।

তাঁর সম্পর্কে ইমাম দারাকুতনী বলেনঃ তিনি একজন দুর্বল রাবী।

হাফিয যাহাবী বলেনঃ মুহাদ্দিছগণ তাঁকে যঈফ বলেছেন।

হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ তিনি সপ্তম স্তরের একজন যঈফ রাবী।

( দেখুনঃ تقريب التهذيب খ-২, পৃ-১০৩ )

৩। আব্দুর রহমান আল বীলমানী।

ইমাম দারাকুতনী বলেনঃ

ضعيف لاتقوم به حجة

তিনি একজন দুর্বল রাবী। তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে না।

( তাক্বরীবুত তাহযীবঃ খ-১, পৃ-৫৬৩ )

ইমাম আবু হাতিম বলেনঃ তিনি " لين " অনির্ভরযোগ্য রাবী।

হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ তিনি তৃতীয় স্তরের একজন দুর্বল রাবী।





★★★ উপরোক্ত বারটি হাদীছ সম্পর্কে আলোচনার নির্যাসঃ

এ সকল হাদীছের বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, শবে বরাত সম্পর্কীয় হাদীছগুলো সূত্রের দিক দিয়ে বিভিন্ন স্তরের। কিছু হাদীছ হাসান (حسن) কিছু হাদীছ মুরসাল (مرسل) এবং কিছু হাদীছ যঈফ (ضعيف) স্তরের। কিন্তু এসব হাদীছকে সমষ্টিগত মিলালে হাদীছ শাস্ত্রের উসূল ও মূলনীতি অনুযায়ী হাদীছগুলো সহীহ কিংবা হাসান-এর (যা সহীহ'ই বটে) স্তরে উন্নীত হয়। আর এর দ্বারাই শবে বরাতের ভিত্তি ও ফযীলতের প্রমাণ মিলে। যা হঠকারিতা ছাড়া অন্য কোনভাবে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মুহাদ্দিছগণ যদিও কোন কোন হাদীছের দোষ ত্রুটি আলোকপাত করেছেন কিন্তু কেউ সেগুলোকে ভিত্তিহীন জাল হাদীছ বা অগ্রহণযোগ্য হাদীছ বলেন নি। যেহেতু প্রতিটি হাদীছ পরস্পর পরস্পরের জন্য সহযোগী স্বরুপ, সেহেতু মুহাদ্দিছীনে কেরামের সমালোচনামূলক এজাতীয় হাদীছ প্রমাণের জন্য কখনো অন্তরায় হতে পারে না। সর্বোপরি হাদীছগুলো যেহেতু ফাযাইলে আমাল এর সাথে সংশ্লিষ্ট, তাই হাদীছ শাস্ত্রের মূলনীতির দৃষ্টিকোণে এ বিষয়ে উদারতা প্রদর্শনের অবকাশ আছে এবং এর উপর আমল করার ক্ষেত্রে অমান্য করার কোন সুযোগ নেই।

অতএব উল্লেখিত বিস্তারিত পর্যালোচনার পর আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, শবে বরাতের সংশ্লিষ্ট এসব হাদীছ সহীহ। কিংবা অন্তত হাসান যা দলীল হিসেবে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। এর পরেও কেউ যদি চোখ বন্ধ করে বলে দেয় যে, শবে বরাতের হাদীছগুলো মওজু বা জাল কিংবা নিতান্তই দুর্বল অথবা এ উক্তি করে বসে যে, শবে বরাতের ফজীলতের কোন ভিত্তি নেই। তাহলে সে ব্যক্তি হাদীছ ও হাদীছের মূলনীতি সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ, সরাসরি স্পষ্ট ভুলে লিপ্ত এবং এ ধরণের উক্তি সহীহ ও হাসান হাদীছকে নয় শুধু বরং পুরো হাদীছশাস্ত্রকে অস্বীকার করারই নামান্তর।

শবেবরাতের হাদীছগুলোর ব্যাপারে মুহাদ্দিছীনে কেরামের অগ্রগণ্য ও চূড়ান্ত অভিমতঃ

প্রথম অভিমতঃ আল্লামা মুবারকপুরী

একারণেই হাফিয মুহাম্মদ আব্দুর রহমান ইবনু আব্দির রহিম আল মুবারকপূরী বলেছেনঃ

" জেনে রাখো যে, শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের হাদীছ এসেছে। যার ফলে শরীয়তে তার ভিত্তি আছে বলে বুঝা যায়। তন্মধ্য থেকে আলোচ্য অধ্যায়ের হাদীছ এবং আয়শা (রঃ) এর হাদীছ, মুআয (রঃ) এর হাদীছ, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রঃ) এর হাদীছ এবং আলী (রঃ) এর হাদীছ। সুতরাং এসব হাদীছের সমষ্টি তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণস্বরূপ যারা শরীয়তের মধ্যে শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই বলে মনে করে। "

( তুহফাতুল আহওয়াজীঃ খ-৩, পৃ-৪৪২, ১৩৫৩, দারুল ফিকির )

দ্বিতীয় অভিমতঃ আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ)

মুহাদ্দিছুল আসর আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) বলেনঃ

" এ রাতটি বরাতের রাত। রাতটির ফজীলত সম্পর্কে সহীহ হাদীছসমূহে এসেছে। "

( আলারফুস শাযীঃ পৃ-১৫৬ )

তৃতীয় অভিমতঃ নাসির উদ্দীন আলবানী


নাসিরুদ্দীন আলবানী শবে বরাত সম্পর্কীয় সকল হাদীছ এক সাথে করে সেগুলোর সনদ নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছেন এবং পর্যালোচনার শেষে তার সার নির্যাস পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরেছেন এভাবেঃ

" সারকথা হলো এ সকল সূত্রের সমষ্টির কারণে (শবে বরাত সম্পর্কীয়) হাদীছ নিঃসন্দেহে সহীহ। কোন হাদীছ অত্যধিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ হলে এর চেয়ে কম সূত্রের মাধ্যমে সহীহ প্রমাণিত হয়। যেমনটি আয়শা (রঃ) এর বর্ণিত হাদীছটি যা অত্যধিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ। সুতরাং কাসেমী হাদীছ পর্যালোচক ও সমালোচকদের থেকে নকল ইসলাহুল মাসাজিদ গ্রন্থে যা উল্লেখ করেছেন যে, শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীছ নেই। তার এ কথার উপর আস্থা রাখা উচিত নয়। "

( সিলসিলাতুল আহাদিসা সহীহাঃ খ-৩, পৃ- ১৮৩ )

চতুর্থ অভিমতঃ শাইখ শুয়াইব আল আরনাউত

সময়কালীন বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক শাইখ শুয়াইব আল আর নাউত মুসনাদে আহমদের টীকায় আব্দুল্লাহ বিন আমর (রঃ) কর্তৃক শবে বরাতের হাদীছটির উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ

" হাদীছটি তার সহযোগী হাদীছগুলো দ্বারা সহীহ বলে বিবেচিত। সহযোগী হাদীছগুলো হচ্ছে

১। আয়শা (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ
২। মুআয বিন জাবাল (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ
৩। আবু মূসা আল আশআরী (রঃ) এর হাদীছ
৪। আবু বকর (রঃ) এর হাদীছ
৫। আবু ছালাবাহ আল খুশানী (রঃ) এর হাদীছ
৬। আবু হুরায়রা (রঃ) এর হাদীছ
৭। আউফ বিন মালিক এর হাদীছ

এ সকল সহায়ক বা সমর্থক হাদীছের প্রত্যেকটির সূত্রের মধ্যে যদিও কিছু অসুবিধা আছে তবে এসব হাদীছের সমষ্টি দ্বারা মূল হাদীছ সহীহ ও শক্তিশালী বলে সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং কাসেমী (রহঃ) হাদীছ পর্যালোচক ও সমালোচকদের থেকে ইসলাহুল মাসাজিদ গ্রন্থে যা উল্লেখ করেছেন যে, মধ্য শা'বানের রাতের ফজীলত সম্পর্কে সহীহ হাদীছ নেই এর অর্থ হলো এ ব্যাপারে কোন হাদীছ সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নেই। কিন্তু সবগুলো হাদীছের সমষ্টিগত সূত্রের দ্বারা হাদীছগুলো পরস্পরে শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে বিষয়টি প্রমাণিত এতে কোন সন্দেহ নেই। "

( মুসনাদে আহমদঃ খ-১১, পৃ-১৬, ৬৬৪২ )

আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা বলেনঃ

" এ রাতের ফজীলতে বেশ কিছু মরফূ হাদীস এবং আছার বর্ণিত আছে যে প্রমাণ করে যে এ রাতটি ফজীলতপূর্ণ। পূর্ববর্তীদের কেউ কেউ এ রাতে বিশেষভাবে সালাত আদায় করতেন। ... যে মতের উপর আমাদের মাযহাবের বা অন্যান্য মাযহাবের বহু সংখ্যক বরং বেশিরভাগ আলেম রয়েছেন তা হলো এই রাতটি অন্যান্য রাতের উপর ফজীলত রাখে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর স্পষ্ট কথার মাধ্যমে এটিই জানা যায়। আর যেহেতু এ বিষয়ে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তীদের আমল সেসকল হাদীসকে সত্যয়ন করে। "

( ইক্তিদাউস সিরাত আল মুস্তাকিম )









হাদিসের আলোকে শবে বরাতের প্রমান (পর্ব ৩) :-


★★★ সপ্তম হাদীছ( صحيح بشواهده )


হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, শাবানের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ তাআলা মুশরিক এবং বিদ্বেষী ছাড়া সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।

উক্ত হাদীসটিঃ

১। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
২। বাযযার তাঁর মুসনাদে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

প্রথম মন্তব্যঃ

এই হাদীছ সম্পর্কে হাফিয হাইছামী বলেনঃ

“ বাযযার তাঁর মুসনাদে এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদে হিশাম ইবনু আবদির রহমান নামক একজন রাবী আছেন। তাঁর পরিচয় আমি জানি না। এছাড়া অন্যান্য সকল রাবী ছিক্বাহ। ”

( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )

দ্বিতীয় মন্তব্যঃ

মাজমাউয যাওয়াদের মুহাক্কিক উক্ত হাদীছে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ

“ এই হাদীছটিকে হিশামের সমর্থন যোগায় মত কেউ বর্ণনা করেন নি এবং হিশাম থেকে আব্দুল্লাহ ইবনে গালিব হাদীছটি নিয়েছেন। ইবনু গালিব একজন নির্ভরশীল রাবী। ”

তৃতীয় মন্তব্যঃ

হাদীছ পর্যালোচক শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব এ হাদীছের ব্যাপারে মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বলের টীকায় আব্দুল্লাহ বিন আমরের সূত্রে হাদীছটিকে উদ্ধৃত করার পর বলেনঃ حديث صحيح بشواهده অর্থাৎ অন্যান্য হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় এ হাদীছটি সহীহ বলে সাব্যস্ত। অতঃপর তিনি হাদীছটির সমর্থনে আরো সাতটি হাদীছ পেশ করেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ হাদীছটি হলো আলোচ্য হাদীছটি। অবশেষে তিনি আবু হোরায়রার উক্ত হাদীছ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ

“ এসব সমর্থিত হাদীছগুলোর প্রত্যেকটির সূত্রে কিছুটা অসুবিধা থাকলেও সব হাদীছের সমষ্টি দ্বারা মূল হাদীছটি সহীহ ও শক্তিশালী হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। অতএব আলোচ্য আবু হোরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত আলোচ্য হাদীছ অন্যান্য হাদীছের সমর্থন পাওয়ায় সহীহ বলে সাব্যস্ত।”

( মুসনাদে আহমদঃ খ-১১, পৃ-৩১৬ )

সার কথাঃ

হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসটিকে একজন রাবীর দুর্বলতার জন্য অনেক মুহাদ্দিসীনগণ একক ভাবে দুর্বল বলেছেন। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী কোন দুর্বল হাদীসের সমর্থনে জন্য অন্য হাদীস থাকে, তাহলে ঐ হাদীসটি আর দুর্বল থাকে না। তখন দুর্বল হাদীসটি হাসান পর্যায়ে চলে যায় আর তা বর্ণনাও করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীসটির সমর্থনে আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ) এর সহীহ হাদীছ, হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ) এর সহীহ হাদীস, হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ) এর হাসান হাদীছ সহ মোট ৮ টি হাদীস পাওয়া যায়। তাই হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী এটি আর দুর্বল থাকবে না, বরং সমষ্টিগত ভাবে সহীহ বা হাসান হয়ে যাবে। তাই তো প্রখ্যাত হাদীস পর্যালোচক আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এর বিশিষ্ট শিষ্য শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব উক্ত হাদীসটিকে সহীহ ও শক্তিশালী বলেছেন।

উপরন্তু ফাযায়েলে আমালের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য, এতে ইমামদের ইজমা রয়েছে। তাই এ হাদীসকে বাতিল বলার কোন অবকাশ নেই।



★★★ অষ্টম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده )


হযরত আউফ ইবনু মালিক (রঃ) থেকে বর্ণিত, রসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ তাতালা শা’বান মাসের পনের তারিখ দিবাগত রজনীতে নিজ সৃষ্টিজীবের উপর বিশেষ রহমত প্রকাশ করেন। তাই মুশরিক ও হিংসাকাতর লোক ব্যতীত সকলকে তিনি ক্ষমা করে দেন।

উক্ত হাদীসটিঃ

১। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
২। বাযযার তাঁর মুসনাদে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

হাদীছটির অবস্থান পর্যালোচনাঃ

উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে হাফিয হাইছামী বলেনঃ

“ বাযযার হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যিয়াদ ইবনু আনআম রয়েছে। যাকে আহমদ ইবনু সালিহ ছিক্বাহ বলেছেন। অথচ অধিকাংশ ইমাম তাকে দুর্বল বলেছেন। আর ইবনু লাহীআহ অনির্ভরযোগ্য। অন্যরা সব ছিক্বাহ তথা নির্ভরযোগ্য। ”

( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )

সারকথাঃ

উপরোক্ত পর্যালোচকদের মন্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে, উক্ত হাদীছে কেবল মাত্র একজন রাবী দুর্বল। আর ইবনু লাহী’আহ অনির্ভরযোগ্য হলেও অগ্রহণযোগ্য নয় কারণ তাঁর হাদীছ তো হাসান। এছাড়া অবশিষ্ট সকল রাবী নির্ভরযোগ্য।

( উল্লেখ্য, ইবনু লাহী'আহ সম্পর্কে যে দুর্বলতার কথা উল্লেখ রয়েছে, তা সহীহ ও হাসান হাদীছের মধ্যে পার্থক্যকারী দুর্বলতা, দুর্বল হাদীস হওয়ার জন্য যে দুর্বলতা, তা নয়। তা আমি আগেই প্রমাণ করে এসেছি। )

যেহেতু হাদীছটি আরো অন্যান্য হাদীছের সহযোগিতা ও সমর্থন পাচ্ছে, সুতরাং হাদীছটি প্রমাণিত বলা যায়। উপরন্ত শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব যিনি সময়কালের বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক, তিনি মুসনাদে আহমদের টীকায় শবেবরাত সম্পর্কিত হাদীছ এর সমর্থনকারী হাদীছ আখ্যা দিয়ে মোট সাতটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। উক্ত হাদীছটি সপ্তম নম্বরে এনেছেন। অতঃপর তিনি হাদীছগুলোর উপর যে মন্তব্য করেছেন তা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এতে প্রমাণিত হয় যে, এসব হাদীছের সনদের ব্যাপারে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য থাকলেও সবগুলো হাদীছ পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতার মা্ধ্যমে সহীহ ও শক্তিশালী বলে সাব্যস্ত।



★★★ নবম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده واسناده مر سل جيد )


কাসীর ইবনু মুররাহ আল হাযরামী থেকে বর্ণিত, হুযুর (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা শাবানের পনের তারিখ রাত্রি অবতরণ করতঃ মুশরিক এবং হিংসাপরায়ণ লোক ছাড়া অন্যান্য সকলের গুনাহ মাফ করে দেন।

উক্ত হাদীছটি

১। ইবনে আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফে
২। হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মুসান্নাফে
৩। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৪। হাফেয মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীবে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

হাদীছটির সূত্রের অবস্থানঃ

শুয়াবুল ঈমানে বর্ণিত সূত্রে রাবীগণের ব্যাপারে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্য নিম্নরূপঃ

১। রাবী আবুল হাসান বিন ফযল আলকাত্তান।

তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলঃ

খতীব বাগদাদী ইবনুল ইমাদ আল হাম্বলী এবং হাফিয যাহাবীসহ অনেকেই তাকে নির্ভরযোগ্য ও বহু হাদীছের বর্ণনাকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

( তারীখে বাগদাদ )

২। আবু সাহাল বিন যায়াদ আল কাত্তান।

তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলোঃ

হাফেয যাহাবী এবং খতীব বাগদাদী তাঁর ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী বলে মন্তব্য করেছেন।

( তারীখে বাগদাদ; সিয়ারু আলামিন নুবালা )

৩। ইসহাক ইবনে হাসান আল হারবী।

তাঁর সম্পর্কে হাফেয যাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ বিন হাম্বল এবং ইবনু হাজার আসকালানী সকলেই বলেছেনঃ

ثقة حجة

অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ও দলীলরূপে সাব্যস্ত।

( দেখুনঃ মীযানুল ইতেদালঃ ১/১৯০ )

৪। আফফান বিন মুসলিম আল বাসারী।

তাঁর সম্পর্কে ইবনে মুঈন আবু হাতিম এবং ইবনু হাজার মন্তব্য করেনঃ

اصحاب الحديث ثقة ثبت متقن

অর্থাৎ বড় মাপের মুহাদ্দিছ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, অতি মজবুত।

৫। আব্দুল ওয়াহিদ বিন যিয়াদ।

তাঁর সম্পর্কে ইবনে সাআদ আবু হাতিম, আবু যুরআ এবং ইবনে হাজার বলেনঃ

ثقة

অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য।

৬। হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্ব।

তাঁর সম্পর্কে আবু যুরআ বলেনঃ

صدوق يدلس

অর্থাৎ সত্যবাদী তবে তাদলীস করেন।

আবু হাতিম বলেনঃ

صدوق يدلس عن الضعفاء يكتب حديثه

অর্থাৎ সত্যবাদী, তাদলীস করেন তবে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য।

( তাহযীবুল কামাল )

ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, হাজ্জাজ ইবনে আরত্বাত্ব ইমাম মাকহূল থেকে হাদীছ শুনেছেন। বহুক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে

سمعت مكحولا

বলে উল্লেখ করেছেন।

( দেখুনঃ তারীখে বাগদাদ )

ইমাম নাসাঈ মন্তব্য করেছেনঃ তিনি তেমন মজবুত নন।

ইবনে হাজার বলেনঃ সত্যবাদী তবে অনেক বেশি ভুল করেছেন।

সময়কালের হাদীছ পর্যালোচক শায়খ আল আরনাউত্ব তাঁর ব্যাপারে মন্তব্য করেনঃ

তিনি সত্যবাদী, হাদীছ বর্ণনায় উত্তম ব্যক্তি, তাদলীস করেন, سمعت বা حدثنا না বললে সে বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হয় না, তাঁর ব্যাপারে বেশি ভুল করার মন্তব্য অতিরঞ্জিত।

( তাহরীর তাকরীবুত তাহযীবঃ ১১১৯ )

৭। মাকহূল (রহঃ)। প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিছ। তিনি সর্বসম্মতিক্রমে

ثقة فقيه تابعى كثير الارسال

নির্ভরযোগ্য, ফিক্বহের ইমাম, তাবেয়ী ও তার ইরসাল করা প্রসিদ্ধ।

হাদীছটির অবস্থান নিয়ে পর্যালোচনাঃ

হাফিয মুনযিরী হাদীছটিকে আততারগীব ওয়াত-তারহীব এ এনেছেন, তিনি বলেনঃ

“ বাইহাকী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এটি একটি চমৎকার মুরসাল হাদীছ। হাদীছটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত আছে। মাকহূল তা বর্ণনা করেছেন। আবু ছা’লাবাহ (রঃ) থেকে সেটিও চমৎকার মুরসাল হাদীছ। ”

সারকথাঃ

হাদীছটি মুরসাল, তবে গ্রহণযোগ্য, উত্তম মুরসাল। মুরসাল হানাফী ও মালেকীদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য। جيد (উত্তম) হলে তো আরো ভাল কথা। তাছাড়া এ হাদীছটি বহু হাদীছের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য ও আমলের ক্ষেত্রে সঠিক বলে সাব্যস্ত।

আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ

উপরে বর্ণিত হাদীসটিই মুরসাল হাদীস এবং উত্তম মুরসাল । যা হানাফী ও মালেকী ইমামদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য, উপরন্তু শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের মুরসাল হাদীস মানার পিছনে যে শর্ত আছে, তাও পূরণ করে।

হাদিসের আলোকে শবে বরাতের প্রমান (পর্ব ২) :-


★★★ ৪র্থ হাদীছ (حسن صحيح لغيره)


হযরত আয়শা (রঃ) বলেন, এক রাতে আমি হুযুর (সঃ) কে বিছানাতে পেলাম না। তাই তাঁকে খোজ করার উদ্দেশ্যে বের হলাম। তখন দেখতে পেলাম তিনি জান্নাতুন বাকীতে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বলে উঠেন, তুমি কি এই আশংকা করছো যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সঃ) তোমার সাথে অবিচার করবে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমি ধারণা করেছিলাম আপনি অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে তাশরীফ নিয়েছেন। হুযুর (সঃ) বললেন, শা’বানের পনের তারিখ রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে তাশরীফ নেন এবং বনু কালব গোত্রের ভেড়া-বকরির পশমগুলোর চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন।

উক্ত হাদীসটিঃ

১। ইমাম তিরমিযী তাঁর তিরমিযী শরীফে
২। ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে
৩। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৪। ইমাম ইবনে আবী শাইবাহ তাঁর মুসান্নাফে
৫। ইমাম বগবী তাঁর শরহেস সুন্নাহয়
৬। ইবনে আহমদ তাঁর মুসনাদে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

হাদীছটির সনদের অবস্থানঃ

প্রথম উক্তিঃ

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হাদীছটির সনদ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ

“ হযরত আয়শা (রঃ) এর হাদীছটি আমরা শুধুমাত্র হাজ্জাজ এর সূত্রে পাই। আর আমি ইমাম বুখারী (রহঃ) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসীর উরওয়া থেকে হাদীছটি শ্রবণ করেননি। আর হাজ্জাজও ইয়াহইয়া থেকে শ্রবণ করেননি। ”

ইমাম তিরমিযীর এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীছটিকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। দুর্বল হওয়ার কারণ হচ্ছে যেহেতু হাদীসের সনদে দুই জায়গাতে ইনক্বিতা (রাবীর সাথে সাক্ষাত না হওয়া বা রেওয়ায়েত শ্রবণ না করা) পাওয়া গেছে। আর তা এভাবে যে, প্রথমত হাজ্জাজ ইবনু আরতাত ইয়াহইয়া ইবনু আবি কাসীর থেকে হাদীছটি শুনেননি। দ্বিতীয়ত, ইয়াহইয়া নিজে উরওয়াহ থেকে হাদীছটি শ্রবণ করেন নি।

উক্ত উক্তির পর্যালোচনাঃ

ইমাম বুখারী (রহঃ) এর উক্ত মতামতের ব্যাপারে আমাদের সবিনয় বক্তব্য হলো, হাজ্জাজ যে ইয়াহইয়া থেকে শ্রবণ লাভ করেননি এই ব্যাপারে মুহাদ্দিছীনে কেরামের মাঝে কোন মতবিরোধ নেই, তবে ইয়াহইয়া যে উরওয়া থেকে শ্রবণ লাভ করেননি, এটা সর্বজনস্বীকৃত কথা নয়। কারণ, ইবনু মঈন প্রমূখ প্রমাণ করেছেন যে, উরওয়া থেকে ইয়াহইয়া শ্রবণ লাভ করেছেন।

যেমনঃ আল্লামা যুরকানী বলেনঃ

“ হাজ্জাজ ইয়াহইয়া থেকে শ্রবণ না করার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। কিন্তু ইয়াহইয়া উরওয়া থেকে শ্রবণ করার বিষয়টিও আবু যুরআহ ও আবু হাতিম প্রত্যাখান করেছেন। আর ইবনু মঈন তা প্রমাণ করেছেন। প্রত্যাখানের চেয়ে প্রমাণই অগ্রগণ্য। ”

( মারিফুস সুনান, আল্লামা মুহাদ্দিস শায়খ ইউসুফ বিননুরীঃ খ-৫, পৃ-৪২০ )

( আমরা যখন কোন কিছুর প্রমাণ পাই না, তখন তাকে ঠিক মনে করি না; কিন্তু এরপর যখন প্রমাণ পাই, তখন তা সঠিক বলে রায় দিই। এখানেও একই ঘটনা ঘটেছে, আবু যুরআহ ও আবু হাতিম প্রমাণ পান নি বলে তা গ্রহণ করেন নি; কিন্তু ইবনু মঈন প্রমাণ পেয়েছেন তাই গ্রহণ করেছেন। তাই যেহেতু আমাদের কাছে এখন প্রমাণ আছে, অতএব আমাদেরকে প্রমাণটিই গ্রহণ করতে হবে। )

অতএব উক্ত ব্যখ্যার আলোকে ইনক্বিতা কেবল এক জায়গাতে থাকে। পরন্ত হানাফী মাযহাবের মুহাদ্দিছীনের মতে এ ধরণের ইনক্বিতা মূল হাদীছ প্রমাণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। যেহেতু তার অন্য রাবীগণতো ছিক্বাহ। অন্য হাদীছের মাধ্যমে তার সমর্থনও বিদ্যমান। এই কারণেই ইবনু হিব্বান তার সহীহ নামক গ্রন্থে হযরত আয়শা (রঃ) এর এই হাদীছটি হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন।

যেমনঃ শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাতে এসেছেঃ

“ শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীছ এসেছে। অধিকাংশরা সেগুলোকে যঈফ বিবেচনা করছেন। ইবনু হিব্বান কয়েকটিকে সহীহ বলেছেন। কিছু হাদীছকে উদারতা প্রদর্শন পূর্বক সহীহ বলেছেন। আর কিছু হাদীছ হাসান হলেও সহীহ বলে দিয়েছেন এবং নিজ সহীহ নামক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। কেননা উভয়টি দ্বারা (সহীহ ও হাসান) দলীল পেশ করা যায়। হযরত আয়শা (রঃ) এর বর্ণিত উক্ত হাদীছটিও এ ধরনেরই। ”

( শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাতঃ খ-৭, পৃ-৪৪১ )

এমনকি হযরত আয়শা (রঃ) এর এই হাদীছটি ইমাম তিরমিযী ছাড়াও

ক) ইমাম ইবনু মাযাহ তাঁর সুনান-এ
খ) ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ তাঁর মুসান্নফ-এ
গ) ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদ এ
ঘ) ইমাম বায়হাকী শুআবুল ঈমান ও ফাযাইলে আওক্বাত অধ্যায়-এ

এবং

ঙ) ইমাম বগভী তাঁর শরহুস সুন্নাহ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু এসব বড় বড় মুহাদ্দিছের মধ্য থেকে কেউই হাদীছটি জাল বলেন নি কিংবা অত্যাধিক দুর্বলও বলেননি বরং হাদীছটির সনদের সমস্ত রাবী ছিক্বাহ এবং অন্য আরো হাদীছের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হাদীছটি শক্তিশালী হয়ে যায়। সুতরাং নিঃসন্দেহে হাদীছটি হাসান এবং সহীহ লিগাইরিহী এর স্তরের।

দ্বিতীয় উক্তিঃ

মুসনাদে আহমদের মুহাক্কিক বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক হামযা আহমদ আয যায়্যান উক্ত হাদীছ সম্পর্কে পরিষ্কার মন্তব্য করেছেন اسناده حسن হাদীছের সূত্র হাসানের স্তরের।

( দেখুনঃ মুসনাদে আহমদের টীকা )

তৃতীয় উক্তিঃ

ইমাম বায়হাকী (রহঃ) উক্ত হাদীছটি সংকলন করার পর বলেনঃ

“ এ হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে হযরত আয়শা, আবু বকর সিদ্দীক এবং হযরত আবু মূসা আশআরী কর্তৃক বর্ণিত হাদীছসমূহ। সুতরাং আলোচ্য হাদীছটি এসকল হাদীছের সমর্থনে সহীহ বলে সাব্যস্ত। তাই শায়খ হামজা আহমদ আযযায়্যান হাদীছটিকে اسناده حسن বলে মন্তব্য করেছেন। ”

সার কথাঃ

হযরত আয়শা (রঃ) এর উপরোক্ত হাদীসটিতে এক জায়গায় ইনতিক্বা পাওয়া যায় আর অনেক বড় বড় ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের মুহাদ্দিসীনের কাছে এ ধরণের ইনতিক্বা মূল হাদীস প্রমাণের ক্ষেত্রে অন্তরায় নয় যদি হাদীসের অন্য রাবীগণ ছিক্বাহ হন।
শায়খ আলবানী (রহঃ) নিজেও এই হাদীসের সমস্ত রাবীকে বিশ্বস্ত বলেছেন।

( সিলসিলাতুস আহাদিসা সহীহা )

অতএব, হাদীসটি হাসান পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সুয়ূতী তদীয় ‘জামিউস সগীর’ গ্রন্থে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

দ্বিতীয়ত, এ হাদীসের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং এর সমর্থনে অনেক হাদীস পাওয়া যায়। যেমনঃ আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ) এর সহীহ হাদীছ, হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ) এর সহীহ হাদীস, হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ) এর হাসান হাদীছ। এমনকি খোদ হযরত আয়েশা (রঃ) থেকেই বিভিন্ন সূত্রে হাদীছের বিভিন্ন কিতাবেই এই হাদীছটি বর্ণিত আছে। তাই সবকিছু একত্রে করে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, হাদীসটি হাসান পর্যায়ের।

ইমাম বায়হাকী
আল্লামা যুরকানী
ইমাম সুয়ুতী
ইমাম ইবনু হিব্বান
শায়খ হামযা আহমদ আয যায়্যান

প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ হাদীছটির হাসান হওয়াতে সত্যায়ন করেছেন।

তৃতীয়ত, এরপরও যদি কেউ হাদীসটিকে দুর্বল আখ্যায়িত করতে চান, তবুও এই হাদীছটি গ্রহণ করা যাবে। কারণ ফাজায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীছ গ্রহণ করা যায়, এতে ইমামগণের ইজমা আছে।



★★★ পঞ্চম হাদীছ( حسن)


হযরত আবু মূসা আল আশআরী (রঃ) রসূলুল্লাহ (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ অবশ্যই আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের পনের তারিখ রাতের বেলায় (সৃষ্টিজীবের) প্রতি মনোযোগ প্রদান করেন। তারপর মুশরিক এবং হিংসুক ব্যতীত সকল মাখলুককে মাগফিরাত ফরমান।

উক্ত হাদীসটিঃ

১। ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে
২। ইমাম বায়হাকী তাঁর ফাযায়িলুল আওক্বাতে
৩। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৪। বাযযার তাঁর মুসনাদে
৫। ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে
৬। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
৭। ইবনে হিব্বান তাঁর সহীহ গ্রন্থে
৮। ইমাম তাবরানী তাঁর কাবীরে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

উক্ত হাদীছের সনদ সম্পর্কে পর্যালোচনাঃ

১। উক্ত হাদীছ ইমাম ইবনু মাজাহ রাশিদ ইবনু সাঈদ ইবনু রাশিদ আররামালী থেকে বর্ণনা করেছেন।

যাঁর সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেনঃ

“ দশম স্তরের একজন সত্যবাদী রাবী। ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৩, পৃ-১৯৬ )

২। ওলীদ ইবনু মুসলিম আল কারশী।

যাঁর সম্পর্কে ইবনু হাজার বলেনঃ

“ তিনি একজন ছিক্বাহ রাবী। মুদাল্লাস রেওয়ায়েত অধিক করেছেন। ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-২, পৃ-২৮৯; খ-১১, পৃ-১৩৪ )

ইবনু সাআদ তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ

“ ওলীদ একজন নির্ভরযোগ্য অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছিলেন। ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১১, পৃ-১৩৪ )

৩। ابن لهيعة ইবনু লাহীআহ।

যার সম্পর্কে হাফিয হাইসামী এর বরাতে পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর হাদীছ হাসান।

৪। ضحاك بن الايمن যাহহাক ইবনু আইমান।

হাফিয ইবনু হাজার এবং হাফেজ জাহাবী বলেন তিনি মাজহুল অর্থাৎ অজ্ঞাত।

( তাহযীবুত তাহযীব; মীযানুল ইতিদাল )

৫। যাহহাক ইবনু আবদির রাহমান আরযাব।

হাফিয ইবনু হাজার, হাফিয আজালী বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য তাবেয়ী। ( তাহজীবুত তাহজীব )

৬। আবু মূসা আল আশআরী (রঃ) তিনি একজন জলীলুল ক্বদর সাহাবী।

হাদীছটির অবস্থানঃ

উল্লেখিত পর্যালোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এই হাদীছের সনদে শুধু মাত্র একজন রাবী অর্থাৎ জাহহাক ইবনু আইমান মাজহূল তথা অপরিচিত। এছাড়া অবশিষ্ট সকল রাবী নির্ভরযোগ্য। আর ইবনু লাহীআর হাদীছ হাসান স্তরের। (এ ক্ষেত্রে) শুধুমাত্র একজন রাবী এর পরিচয় জানা না থাকলে মূল হাদীছ প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনরূপ অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে না। কারণ এই হাদীছের অনুকূলে ও সমর্থনে আরও হাদীছ তো অবশ্যই পাওয়া যায়। আর আমরা শুরুতে একথা বলে আসছিলাম যে, যঈফ রেওয়ায়েত যদি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়, তাহলে ‘হাসান’ স্তরে উন্নীত হয়।

এ জন্যই সমকালীন হাদীছ পর্যালোচক আল্লামা নাসির উদ্দীন আলবানী আবু মূসা আশআরী (রঃ) এর হাদীছকে صحيح سنن ابن ماجه গ্রন্থে হাসান হিসেবে প্রমাণিত করেছেন।

( দেখুনঃ সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, আলবানীঃ খ- ১, পৃ- ২৩৩ )

সার কথাঃ

হযরত আবু মূসা আশআরী (রঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটিতে একজন অজ্ঞাত রাবী আছেন। কিন্তু যেহেতু এই হাদীছের সমর্থনে হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ), হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রঃ) এর শক্তিশালী সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে, তাই উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী হাদীসটি দুর্বল হবে না, হাসান হয়ে যাবে।

এজন্যই আহলে হাদীছ বা সালাফীদের অন্যতম গণ্যমান্য ব্যক্তি আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন এবং তাঁর সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহতে উল্লেখ করে প্রমাণও করেছেন।



★★★ ষষ্ঠ হাদীস( حديث ضعيف صحيح بشواهده)


হযরত আবু ছা’লাবাহ আল খুশানী (রঃ) থেকে বর্ণিত রসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে স্বীয় বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুমিনগণকে ক্ষমা করেন, কাফিরদেরকে সুযোগ দেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে তাদের বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা পর্যন্ত অবকাশ দেন।

উক্ত হাদীসটিঃ

১। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
২। ইমাম তাবরানী তাঁর কাবীরে
৩। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে

সংকলন করেছেন।

░▒▓█► হাদীসটির মান :

উক্ত হাদীছের সনদ পর্যালোচনাঃ

প্রথম উক্তিঃ

হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী হাদীছটিকে বর্ণনা করার পর বলেনঃ

“ ইমাম বায়হাকী (রহঃ) বলেছেনঃ এই হাদীছের সনদে মাকহূল এবং আবু ছা’লাবাহ এর মাঝখানে ইরসাল (রাবী এর বিলুপ্তি) রয়েছে। ”

আর আমরা ভূমিকাতে (উসূলে হাদীসের নীতিমালায়, ৮ম পর্ব) উল্লেখ করেছিলাম যে, হানাফী ও মালেকী মুহাদ্দিছদের মতে মুরসাল হাদীছ সহীহ এবং প্রমাণ পেশ করার যোগ্য।

এ হাদীছের সূত্রে একজন রাবী রয়েছেন, আল আহওয়াজ ইবনু হাকীম।

দ্বিতীয় উক্তিঃ

তাঁর ব্যাপারে হাফেজ হায়ছামী মন্তব্য করেন এভাবেঃ

হাফিয হাইছামী বলেনঃ উক্ত হাদীছ তাবরানী বর্ণনা করেছেন। তার সনদে আহওয়াস ইবনু হাকীম নামক একজন রাবী আছেন। তিনি দুর্বল।

( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )

তৃতীয় উক্তিঃ

অন্য দিকে তার ব্যাপারে শায়খে বুখারী আলী ইবনু মাদীনী বলেনঃ والاحوص ثقة আহওয়াস নির্ভরযোগ্য।

( তাহযীবুল কামাল )

চতুর্থ উক্তিঃ

সর্বাধিক উত্তম মন্তব্য করলেন ইমাম দারাকুতনী (রহঃ)। তিনি বলেনঃ

والاحوص يعتبر اذا حدث عنه ثقة

আহওয়াস হতে যখন নির্ভরযোগ্য রাবী রেওয়ায়েত নিবেন তখন সে হাদীছ গ্রহণযোগ্য হবে।

সুতরাং এখানে আহওয়াস থেকে বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমান আল মোহারেবী নামক রাবী যিনি সর্বসম্মতিক্রমে নির্ভরযোগ্য। কাজেই আহওয়াসের কারণে আলোচ্য হাদীছের সূত্রকে দুর্বল বলার কোন অবকাশ নেই। সূত্রের অন্যান্য রাবীগণ ছিক্বাহ। তবে এ সূত্রের মধ্যে মাকহূল রাবী এবং হাদীছ বর্ণনাকারী সাহাবী উভয়ের মাঝে একজন রাবী বিলুপ্ত। অথাৎ রেওয়াতটি মুরসাল। এছাড়া অন্য কোন সমস্যা এ সূত্রে নেই। এ ধরণের হাদীছের সমর্থনে আরো হাদীছ বিদ্যমান থাকায় হাদীছটি সহীহ বলে বিবেচ্য। নূন্যতম হাদীছটি মুরসাল যা হানাফী ও মালেকী মুহাদ্দিছদের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে সাব্যস্ত।

সারকথাঃ

হাফিয হাইছামী এর বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, এই হাদীছের সনদে একজন দুর্বল রাবী আছে, তিনি ছাড়া অন্যান্য রাবীগণ ছিক্বাহ। এই দৃষ্টিকোণে যদিও হাদীছটি দুর্বল। কিন্তু তার সমর্থনে হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ), হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ), হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর (রঃ) এর সহীহ হাদীছসহ আরো হাদীছ থাকায় উসূলে হাদীছের নীতিমালা অনুযায়ী হাদীছটি আর দুর্বল থাকে না।

আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ

প্রথমত, উপরে বর্ণিত তিনটি হাদীসের প্রথমটির সনদ হাসান পর্যায়ের, আর বাকী দুইটি কিছুটা দুর্বল।

দ্বিতীয়ত, হাদীস গুলোর সমর্থনে আরও অনেক হাদীস থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী এই হাদীস গুলো হাসান বা সহীহের পর্যায়ে চলে আসে।

তৃতীয়ত, হাদীসগুলো কিছুটা দুর্বল হলেও ফাজায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীছ গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য। এটি উসূলে হাদীসের অন্যতম একটি নীতিমালা।

অনেক বড় বড় মুহাদ্দিসরাই এই হাদীস গুলোর তাহকীক করেছেন এবং এগুলোকে সামষ্টিকভাবে হাসান বলে রায় দিয়েছেন।

হাদিসের আলোকে শবে বরাতের প্রমান (পর্ব ১) :-



এখানে সর্বমোট ৩ টি হাদিস সনদ সহ মান সহ বিস্তারিত বর্ননা করা হল :



★★★ ০১. হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) এর হাদীস-

5665 - أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُعَافَى الْعَابِدُ بِصَيْدَا، وَابْنُ قُتَيْبَةَ وَغَيْرُهُ، قَالُوا: حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ خَالِدٍ الْأَزْرَقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو خُلَيْدٍ عُتْبَةُ بْنُ حَمَّادٍ، عَنِ الْأَوْزَاعِيِّ، وَابْنِ ثَوْبَانَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ مَكْحُولٍ، عَنْ مَالِكِ بْنِ يُخَامِرَ عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ»

অর্থ : হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-অর্ধ শাবানের রাতে [শবে বরাতে]আল্লাহ তাআলা তাঁর সমস্ত মাখলুকের প্রতি মনযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।

★ সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬৬৫,

★ মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-২৭৫৪,

★ মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াই, হাদীস নং-১৭০২,

★ তাবারানী : আল মুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৭৭৬,

★ আল মুজামুল কাবীর, হাদীস নং-২১৫,

★ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩৯০,

★ মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২০৩,

★ মুসন্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩০৪৭৯,

★ শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৬২০৪

★ শো’আবুল ঈমান হাদীস নং-৩৫৫২

★ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং- ১/৪৪৫;

★ মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং- ২/১৭৬;

★ সুনানে বায়হাকী, হাদীস নং- ৩/৩৮১; হাদীসটি সহীহ

★ কিতাবুস সুন্নাহ-১/২২৪, হাদীস-৫১২,

★ আল ইহসান-৭/৪৭,

★ মাওয়ারিদুয যমআন-৪৮৬, হাদীস-১৯৮০,

★ মাজমাউ যাওয়াইদ-৮/৬৫,

★ সিলসিলাতুস সহীহা-৩/১৩৫, হাদীস-১১৪৪,

★ আততারগীব-২/২৪২


░▒▓█► হাদীসটির মান :

হাদীসটি সম্পূর্ণ সহীহ




হাদীছটির সনদ পর্যালোচনাঃ

ইবনে হিব্বানের সূত্রে এই হাদীছে দশজন বর্ণনাকারী রয়েছেনঃ

১। মুহাম্মদ বিন আল মাআফী

তিনি সকলের নিকট নির্ভরযোগ্য।

( দেখুন কিতাবুছ ছেকাত )

২। ইবনে কুতায়বা

তিনি মুহাদ্দিছীনের দৃষ্টিতে ثقه ছিকাহ তথা নির্ভরযোগ্য।

( দেখুন আল আনসাব )

৩। হিশাম ইবনে খালিদ

তার ব্যাপারে সমকালীন হাদীছ পর্যালোচক শুআইব আল আরনাউত বলেনঃ

“ তিনি নির্ভরযোগ্য, প্রচুর ছিক্বাহ রাবীগণ তাঁর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন,

ক) আবু আলী আল হায়্যানী
খ) ইমাম যাহাবী

প্রমুখ তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন।

গ) ইবনে হিব্বান কিতাবুছ ছিক্বাতে বলেন, কোন সমালোচনা আমার জানা নেই। ”

( তাহরীরঃ খ-৪, পৃ-৩৯ )

৪। উতবা বিন হাম্মাদ

এর সম্পর্কে হাদীছ পর্যালোচকগণ বলেছেনঃ

ক) হাফেয বলেনঃ তিনি সত্যবাদী।

খ) আবু আলী নিসাপুরী এবং খতীব বাগদাদী বলেনঃ তিনি নির্ভরযোগ্য।

গ) ইবনে হিব্বান তাঁকে কিতাবুছ ছিক্বাতে উল্লেখ করেছেন।

ঘ) শুয়াইব আরনাউত তাঁকে ছিক্বাহ বলেছেন।

তাঁর থেকে অসংখ্য ছিকাহ মুহাদ্দিস হাদীছ নিয়েছেন।

( দেখুন তাহরীরঃ খ-২, পৃ-৪২৯ )

৫। আলআওযায়ী

তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সুখ্যাত ইমাম ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি।

( দেখুন আল জরহু ওয়াততাদীল )

৬। আব্দুর রহমান ইবনে ছওবান।

তাঁর ব্যাপারে হাদীছ পর্যালোচকদের কিছু সমালোচনা থাকলেও তাঁর ব্যাপারে শায়খ আরনাউত্ব সুস্পষ্টভাষায় বলেন,

“ তিনি সত্যবাদী, তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য কেননা

ক) আবু হাতিম
খ) দুহাইম
গ) আব্দুর রহমান বিন সালেহ আমর বিন আলী

প্রমুখ ثقه ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।

ঘ) ইবনে হিব্বান তাঁকে কিতাবুছ ছিকাতে উল্লেখ করেছেন।

ঙ) শায়খে বোখারী আলী ইবনিল মাদীনী ইমাম আবু যুরআহ
চ) ইমাম আবু দাউদ আল আজলী
ছ) ইয়াকুব ইবনে শাহীন

প্রমুখ তাঁর হাদীছ গ্রহণযোগ্য হওয়ার ক্ষেত্রে “ কোন অসুবিধা নেই ” বলে মন্তব্য করেছেন। ”

( দেখুন তাহরীরঃ পৃ – ২/ ৩১০ )

৭। ছাবেত ইবনে ছওবান

তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ছিক্বাহ নির্ভরযোগ্য।

( দেখুন আততাকরীবঃ ৮১১)

৮। ইমাম মাকহূল

তিনি প্রসিদ্ধ ইমাম ও ছিকাহ হওয়ার মধ্যে কারো দ্বিমত নেই।

তাঁর ব্যাপারে ইবনু হাজার বলেনঃ

“ নির্ভরযোগ্য তবে ইরসাল বেশি করতেন। ”

( উস্তাদের নাম বিলুপ্ত করে তার উপরস্ত ব্যক্তি থেকে হাদীছ বর্ণনা করাকে ইরসাল বলে। )

৯। মালেক ইবনে ইখামের

তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ছিক্বাহ।

মুআয বিন জাবালের সঙ্গী। তবে রসূলের ইন্তিকালের পর ইসলাম গ্রহণ করেন।

তাঁর ব্যাপারে “ আল-কাশেফ ” গ্রন্থে আছে,

“ তিনি হযরত মুআযের সঙ্গি, সাহাবী নন, নির্ভরযোগ্য। ”

( দেখুন কাশিফঃ ১/২৮১)

১০। হযরত মুআয (রঃ)

রসূল (সঃ) এর বিশিষ্ট ও সুপ্রসিদ্ধ ফক্বীহ সাহাবী।

( দেখুন আততাকরীব)





★★★ হাদীছটি সম্পর্কে মুহাদ্দিছগণের অভিমতঃ


★ হাফিয নুরুদ্দীন আলী ইবনে আবু বকর আল হাইসামী (মৃঃ ৮০৭) তাঁর ‘ মাজমায়ুয যাওয়ায়িদ ’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,

“ উক্ত হাদীছটি তাবরানী তাঁর ‘ আল-মুজামুল কাবীর ’ এবং ‘ আওসাত ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। উভয় গ্রন্থে রাবী ছিক্বাহ তথা বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। ”

( মাজমায়ুয যাওয়ায়িদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )



★ হাফিয ইবনে রজব আল হাম্বলী (রহঃ) মু’আয ইবনু জাবাল (রঃ) এর বর্ণিত এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, ইবনু হিব্বান হাদীছটিকে সহীহ (বিশুদ্ধ) আখ্যা দিয়েছেন। আর নির্ভরযোগ্যতার জন্য এটিই যথেষ্ট।

( লাতাইফ আল মারিফঃ ইবনে রজব, ১/২২৪ )

হাদীছ পর্যালোচক আদনান আবদুর রহমান বলেন, উক্ত হাদীছটি ফাযায়িলুল আওক্বাত অধ্যায়ে ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেছেন। আর তার সনদ হাসান।


★ আলোচ্য হাদীছ সম্পর্কে তাবরানী রচিত المعجم الكبير আলমু’জামিল কবীর গ্রন্থের মুহাক্কিক এবং বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক বলেনঃ

“ শবে বরাতের হাদীছটি বহু সূত্রে বর্ণিত আছে। যারা সূত্রগুলো সম্পর্কে অবগত তাদের নিকট হাদীছটি নিঃসন্দেহে সহীহ বলে পরিগণিত। বিশেষ করে যখন তার কিছু সূত্র حسن لذاته হাসান লিযাতিহী তথা সহীহ, যেমন হযরত মুআয (রঃ) ও হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের সূত্রগুলো। ”

( দেখুনঃ আলমু’জামুল কবীরের টিকাঃ খঃ ২০, পৃঃ ১০৮ )

উপরোক্ত মন্তব্যের সারমর্ম হলো মু’আয (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত শবে বরাতের হাদীছটি মতনের দিক দিয়ে সহীহ, তবে তার সনদটি হাসান লিযাতিহী।



★ ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.-৩৫৪) বলেন, হাদীসটি সহীহ। সহীহ ইবনে হিব্বান-১২/৪৮১, হাদীস-৫৬৬৫।

★ আহলে হাদীসদের মহাগুরু শায়খ নাসীর উদ্দীন আলবানী(১৪২০) বলেন-

سلسلة الأحاديث الصحيحة وشيء من فقهها وفوائدها (3/ 135)
1144 - " يطلع الله تبارك وتعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن ".
حديث صحيح، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا وهم معاذ ابن جبل وأبو ثعلبة الخشني وعبد الله بن عمرو وأبي موسى الأشعري وأبي هريرة وأبي بكر الصديق وعوف ابن مالك وعائشة.

উক্ত হাদীসটি সহীহ, যা সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর এক বড় জামাত বর্ণনা করেছেন এবং একটি হাদীস অন্য হাদীস এর সনদকে আরো মজবুত করে তুলে। সাহাবীদের থেকে বর্ণনাকারীগণ হলেন :

(০১) হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)

(০২) আবূ সালাবা আল খাসানী (রা.)

(০৩) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা)

(০৪) আবূ মূসা আল আশআরী (রা.)

(০৫) আবূ হুরায়রা (রা.)

(০৬) আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)

(০৭) আউফ ইবনে মালেক (রা.)

(০৮) হযরত আয়েশা (রা.)।

Reference : সিলসিলাতুস সহীহা-৩/১৩৫, হাদীস-১১৪৪।


উপরে বর্ণিত সবক’টি বর্ণনাকারীর হাদিস তিনি তার কিতাবে আনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ আলোচনার পর শেষে তিনি বলেন-

و جملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منهاعددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث ، فما نقلهالشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في ” إصلاح المساجد ” ( ص ১০৭ ) عن أهل التعديلو التجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح ، فليس مما ينبغيالاعتماد عليه ، و لئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبلالتسرع و عدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك . و الله تعالى هو الموفق

অর্থাৎ “সারকথা হল এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহীহ, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর সহীহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ না মারাত্মক কোন দুর্বলতা থেকে বেঁচে যায়, যেমন এই হাদিসটি হয়েছে। আর যা বর্ণিত শায়েখ কাসেমী থেকে তার প্রণিত “ইসলাহুল মাসাজিদ” গ্রন্থের ১০৭ নং পৃষ্ঠায় জারাহ তা’দীল ইমামদের থেকে যে, “শাবানের অর্ধ মাসের রাতের কোন ফযীলত সম্পর্কে কোন হাদিস নেই মর্মে” সেই বক্তব্যের উপর নির্ভর করা যাবেনা। আর যদি কেউ তা মেনে নেয় সে হবে ঝাঁপিয়ে পড়া(ঘারতেড়া) স্বভাবের, আর তার ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ ও গবেষণা-উদ্ভাবনের কোন যোগ্যতাই নেই এরকমভাবে যেমন আমি করলাম”। শায়েখ আলবানী এর বিশ্লেষণ থেকে একথা নির্ধিদ্ধায় আমরা বলতে পারি হাদিস দ্বারা শবে বারাআত প্রমাণিত।


★ আল্লামা মুনজেরী (রহ.-৬৫৬) বলেন উক্ত হাদীসটি সহীহ। আত তারগীব ওয়াত তারহীব-২/৭৩, হাদীস-১৫৪৬।

★ আল্লামা হায়সামী (রহ.-৮০৭) বলেন-

مجمع الزوائد ومنبع الفوائد (8/ 65)
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الْكَبِيرِ وَالْأَوْسَطِ وَرِجَالُهُمَا ثِقَاتٌ.

উক্ত হাদীসটি ইমাম তাবরানী তার মুজামুল কাবীর ও আওসাতে সংকলন করেছেন, এবং সংকলিত হাদীস এর সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।
মাজমাওজ যাওয়েদ-৮/৬৫, হাদীস-১২৯৬০।


★ আল-আরনাওত এই সনাদকে সহীহ বলেছেন;

★ ইমাম মনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন।

Reference : আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮; ৩/৪৫৯. লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১।






★★★ দ্বিতীয় হাদীছ (الصحيح درجة فى حسن)


হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রঃ) থেকে বর্ণিত, হুযুর (সঃ) বলেছেনঃ শাবান মাসের পঞ্চদশ রজনীর আগমণ হলে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আসমানে তাশরীফ আনেন এবং স্বীয় বান্দাদিগকে মাফ করে দেন। কিন্তু মুশরিক ও অপর ভাইয়ের সাথে হিংসা পোষণকারী ব্যতীত।

উক্ত হাদীসটিঃ

১। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
২। ইমাম উকায়লী তাঁর যয়ীফা আল কাবীর
৩। বাযযার তাঁর মুসনাদে
৪। ইমাম মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীব
৫। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
৬। ইবনে খোযাইমা তাঁর তাওহীদে

সংকলন করেছেন।


░▒▓█► হাদীসটির মান :

হাদীছটি সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রবিদগণের অভিমতঃ

প্রথম অভিমতঃ

হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী (মৃঃ ৬৫৭ হিঃ) বলেনঃ বাযযার ও বাইহাকী এই হাদীছটিকে لاباس به (সনদে কোন সমস্যা নেই) সনদের সাথে বর্ণনা করেছেন।

( তারগীব ওয়াত তারহীবঃ খ-৪, পৃ-২৩৮ )

উল্লেখ্য মুহাদ্দিছগণ কোনো হাদীছের ক্ষেত্রে لاباس به বলার অর্থ হাদীছটি শক্তিশালী হওয়ার প্রতি নির্দেশক।

দ্বিতীয় অভিমতঃ

হাফিয আল-হাইছামী বলেনঃ হাদীছটি বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে আব্দুল মালিক ইবনে আবিদিল মালিক নামক একজন রাবী (বর্ণনাকারী) আছে। ইবনু আবি হাতিম যাকে جرح و تعديل জরাহ ওয়াত তাদীল (দোষ-ত্রুটি পর্যালোচনা) এ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাকে য’ঈফ তথা দুর্বল আখ্যা দেন নি। তাছাড়া অবশিষ্ট অন্যান্য রাবী ছিক্বাহ তথা নির্ভরযোগ্য।

( মাজমাউয যাওয়ায়েদ )

বলা বাহুল্য, ইবনু আবি হাতিম যদি কোন রাবী এর দোষ-ত্রুটি পর্যালোচনার ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেন, তখন তার অর্থ হচ্ছে, রাবী নির্ভরযোগ্য। তাই এই দৃষ্টিকোণে উক্ত হাদীছটির সকল রাবী ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য।

এ প্রসঙ্গে قواعد فى علوم الحديث এ আল্লামা যফর আহমদ ওছমানী (রহঃ) বলেনঃ

“ তাঁর অবদান এই যে, ইবনু আবি হাতিম কোনো রাবী এর দোষ-ত্রুটি পর্যালোচনা করার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকার অর্থ দাঁড়ায় ওই রাবী ছিক্বাহ ও নির্ভরযোগ্য। ঠিক ইমাম বুখারী (রহঃ) এর নীরবতা অবলম্বন করার মতো। ”

( ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছঃ পৃ-৩৫৮ )

তৃতীয় অভিমতঃ

হাফিয ইবনু আদী আল জুরজানী (মৃঃ ৩৬৫) বলেনঃ আমি ইবনু হাম্মাদকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেছেন, আব্দুল মালিক ইবনু আবদিল মালিক মুস’আব ইবনু আবি যিব থেকে আর তার (আব্দুল মালিক ইবনু আবদিল মালিক) থেকে আমর ইবনু হারিস এর বর্ণনা করার বিষয়টি বিবেচনার বিষয়। (অতঃপর হাফিয ইবনু হাদী আল জুরজানী বলেন) আবদুল মালিক ইবনু আবদিল মালিক হাদীছটির সাথে মারূফ। আ’মর বিন হারিস ব্যতীত উক্ত হাদীছটি আবদুল মালিক থেকে আর কেউই বর্ণনা করে নি। আর হাদীছটি এই সনদের সাথে মুনকার।

উক্ত অভিমতের পর্যালোচনাঃ

১। ইমাম বুখারী (রহঃ) আবু বকর সিদ্দীক (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীছটির ব্যাপারে যে বলেছেন وفيه نظر তথা তার মধ্যে বিবেচনার বিষয় রয়েছে - এর দ্বারা মূল হাদীছটি সহীহ প্রমাণ হওয়ার ব্যাপারে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় না।

উল্লেখ্য যে, ইমাম বুখারী (রহঃ) এ হাদীছের সূত্রকে وفيه نظر বলার মূল কারণ হলো “ عبد الملك بن عبد الملك ” নামক রাবী তাঁর দৃষ্টিতে দুর্বল হওয়ার দরুণ, অন্যথায় এ হাদীছের সূত্রের অন্য কোন রাবীর ব্যাপারে কারো কোন আপত্তি নেই।



চতুর্থ অভিমতঃ

ইমাম উকায়লী (রহঃ) আলোচ্য হাদীছটিকে তার الضعفاءالكبير গ্রন্থের বিবরণ তুলে ধরে মন্তব্য করেন যে,

পঞ্চদশ শা’বান রজনীতে আল্লাহতাআলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন মর্মে যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে لين তথা কিছু কমজুরী রয়েছে। তবে প্রত্যেক রাতে আল্লাহ তাআলার অবতরণের কথা বহু সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কাজেই মধ্য শাবানের রজনীতেও মহান আল্লাহর অবতরণের বিষয়টি এসব সহীহ হাদীছেরই অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত।

( যয়ীফা আল কাবীরঃ খ-১, পৃ-২৯)

সুতরাং নুযুলে রবের হাদীছ দ্বারা হাদীছে আবী বকরের পূর্ণ সমর্থন পাওয়ায় হাদীছটি শক্তিশালী হয়ে উঠায় মূল হাদীছকে সহীহ বলতে হবে।

পঞ্চম অভিমতঃ

ইমাম তাবরানী (রহঃ) তার স্বীয় ( المعجم الكبير ) গ্রন্থে হাদীছটিকে উল্লেখ করার পর এ কিতাবের মুহাক্কিক বলেনঃ

এ হাদীছটি বহু সূত্রে বর্ণিত। যারা এ ব্যাপারে অবগত আছে তাদের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে এটি সহীহ বলে সাব্যস্ত। বিশেষ করে যখন এ ব্যাপারে কয়েকটি হাদীছ “ حسن لذاته ” তথা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত। যেমনঃ হযরত মুয়ায (রঃ) ও হযরত আবু বকর (রঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছগুলো।

( মুজামুল কাবীরঃ খ-২০, পৃ-১০৮ )

এতে প্রমাণিত হয় যে, শবে বরাত সম্পর্কীয় হাদীছসমূহে হযরত মুয়ায ও আবু বকর থেকে বর্ণিত হাদীছগুলো সূত্রের দিক দিয়ে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্রভাবে সহীহ বলে সাব্যস্ত।

সার কথাঃ

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রঃ) কর্তৃক বর্ণিত আলোচ্য হাদীছটি সহীহের অন্তর্ভুক্ত।

হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী
ইমাম তাবরানী
ইমাম উকায়লী
হাফিয আল-হাইছামী

প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসগণ হাদীসটির সহীহ হওয়াতে সত্যয়ন করেছেন।





★★★ তৃতীয় হাদীছ (حسن)


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এর হাদীস-

مسند أحمد (6/ 197)
6642 - حدثنا حسن حدثنا ابن لَهِيعة حدثنا حييُّ بن عبد الله عن أبي عبد الرحمن الحُبُلّي عن عبد الله بن عمرو، أن رسول الله -صلي الله عليه وسلم - قال: "يطَّلعُ الله عَزَّ وَجَلَّ إلي خلقه ليلةَ النصف من شعبان، فيغفر لعباده، إلا لاثنين: مشاحنٍ، وقاتِلِ نفسٍ".

অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ১৫ই শা’বানের রাত্রে আল্লাহ পাক তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেন দুই ব্যক্তি ছাড়া। এক. পরশ্রীকাতর। দুই. অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যাকারী।

Reference :

★ মুসনাদে আহমদ-৬/১৯৭, হাদীস-৬৬৪২,

★ মাজমাউস জাওয়ায়েদ-৮/৬৫, হাদীস-১২৯৬১,

★ আত তারগীব ওয়াত তারহীব লিল মুনজেরী-৩/৩০৮, হাদীস-৪৮৯২।


░▒▓█► হাদীসটির মান :


উক্ত হাদীসটি হাসান তথা প্রমাণযোগ্য।

★ হাদীস এর সূত্রের মাঝে একজন বর্ণনাকারী হলেন ‘‘ইবনে লাহিয়া’’ কতক ইমাম তার সিকাহ বা নির্ভর হওয়ার বিষয়ে দ্বিমত পোশন করেছেন কিন্তু সঠিক সমাধান :-
★ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.),
★ ইমাম আবূ হাফস ওমর ইবনে শাহিন (রহ.),
★ আহমদ ইবনে সালেহ আল মিসরী, তাকে সিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।

★ ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে ওহাব আল মিসরী বলেন- الصادق البار
★ ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে ইউসূফ ইবনে খেরাশ (রহ.) বলেন- يكتب حديثه
★ হফেজ যাহাবী (রহ.) বলেন-ذكره في الكاشف ، وقال : العمل على تضعيف حديثه
★ আর আল্লামা হায়সামী (রহ.) বলেন-
رَوَاهُ أَحْمَدُ، وَفِيهِ ابْنُ لَهِيعَةَ وَهُوَ لَيِّنُ الْحَدِيثِ، وَبَقِيَّةُ رِجَالِهِ وُثِّقُوا.

★ অন্যত্র আল্লামা হায়সামী (রহ.) তার সূত্রে বর্ণিত হাদীসকে হাসান বলে মন্তব্য করেছেন।

❀ এছাড়াও ইমাম মুসলিম (রহ.) তার সহীহ মুসলিমে ‘‘ইববে লাহিয়ার’ সনদে বর্ণিত হাদীসকে উল্লেখ করছেন-

অতঃপর ইমাম মুসলিম (রহ.) নিজ উস্তাদ আল্লামা মুরাদী (রহ.-২৪৮) এর উক্তি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বলেন নিন্ম হাদীসটি আমি শুনেছি ইবনে ওহাব থেকে, তিনি ‘‘ইবনে লাহিয়া’’ থেকে, তিনি আমর ইবনে হারেস থেকে বর্ণনা করেছেন।
সহীহ মুসলিম-১/৪৩৫, হাদীস-৬২৪।



এ হাদীছ সম্পর্কে হাদীছ বিশারদগণের উক্তিঃ

প্রথম উক্তিঃ

আল মুনযিরী হাদীছটিকে আততারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে উল্লেখ করে বলেছেনঃ হাদীছটি ইমাম আহমদ (রহঃ) লায়্যিন (শিথীল) সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন।

( আত তারগীব ওয়াত তারহীবঃ খ-৪, পৃ-২৩৯ )

দ্বিতীয় উক্তিঃ

আল হাইসামী বলেনঃ হাদীছটি ইমাম আহমদ (রহঃ) বর্ণনা করেছেন। তার সনদে ইবনু লাহীআহ নামক জনৈক রাবী রয়েছেন, হাদীছে তার নির্ভরযোগ্যতা দুর্বল। এছাড়া উক্ত হাদীছের অবশিষ্ট রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।

( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )

হাফিয আল হাইসামী এর এই উক্তি দ্বারা বুঝা যায় যে, উক্ত হাদীছের সনদে ইবনু লাহীআহ ব্যতীত অন্যান্য সকল রাবী ছিক্বাহ তথা নির্ভরযোগ্য। শুধু মাত্র ইবনু লাহীআহ সম্পর্কে মুহাদ্দিছগণ প্রশ্ন তুলেছেন।

কে ইবনু লাহীআহ, নিম্নে তার পরিচয় এবং মুহাদ্দিছদের দৃষ্টিতে হাদীছ শাস্ত্রে তার অবস্থানও আলোকপাত করা হলোঃ

ইবনু লাহীআহ সম্পর্কে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্যঃ

আব্দুল্লাহ ইবনু লাহীআহ ইবনে আকবাহ ইবনু ফাআন ইবনু সাওবান আল হাযরামী হাদীছ শাস্ত্রের একজন রাবী।

১। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসাঈ প্রমুখও তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

( অতএব, যারা ইবনু লাহীআহকে দুর্বল মনে করে এই হাদীসকে দুর্বল বলে রায় দেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনাদের মতানুসারে তাহলে তো সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে ইবনু লাহীআহ কর্তৃক বর্ণনাকৃত হাদীসও দুর্বল হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাদের কাউকেই তো কখনো বুখারী শরীফের কোন হাদীসকে দুর্বল বলতে শুনি নি !! )

২। ইবনু সালাহ বলেনঃ ইবনু লাহীআহ বাহাত্তর জন তাবিঈর সাক্ষাত লাভ করেছেন।

( দেখুনঃ ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীবঃ ৫ম খঃ পৃঃ ৩২৭-৩২৮ )

৩। কোন কোন কট্টরপন্থী হাদীছ বিশারদ যেমনঃ ইবনু মঈন, আলী ইবনুল মাদীনী প্রমূখের মতে ইবনু লাহীআহ একজন দুর্বল রাবী। যথা এ সুবাদে ইবনু মঈন এর বক্তব্য হচ্ছেঃ

“ ইবনু লাহীআহ একজন যঈফ রাবী। তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে না। ”

( দেখুনঃ সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৮, পৃ-২১; তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩৩১; মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৫ )

৪। আর আলী ইবনুল মাদীনী তাঁর সম্পর্কে বলেছেনঃ

“ আমাকে বিশর ইবনুস সিররী বলেছেনঃ যদি তুমি ইবনু লাহীআহকে দেখতে তাহলে তার প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে না। ”

( দেখুনঃ তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩৩১; মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৬ )

৫। কিন্তু অধিকাংশ মুহাদ্দিস ইবনু লাহীআহকে ছিক্বাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

যেমনঃ ইমাম আহমদ (রহঃ) বলেনঃ

“ অধিক হাদীছ বর্ণনা, সংরক্ষণ এবং নিখুঁত হাদীছের ক্ষেত্রে মিশরে ইবনু লাহীআহ এর সমকক্ষ আর কে হতে পারে? ”

( সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৮, পৃ-১৩; মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৭; তাযকিরাতুল হুফফাজঃ খ-১, পৃ-২৩৮ )

৬। ইমাম ছওরী (রহঃ) বলেনঃ

“ ইবনু লাহীআহ এর কাছে রয়েছে হাদীছশাস্ত্রের মূলনীতি আর আমাদের কাছে রয়েছে শাখা-প্রশাখা। ”

( তাযকিরাতুল হুফফাজঃ খ-১, পৃ-২৩৯; তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩২৬; সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৮, পৃ-১৩ )

৭। ইবনু ওহাব বলেনঃ

“ আল্লাহর কসম, আমাকে সৎ ও সত্যবাদী আব্দুল্লাহ ইবনু লাহীআহ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ”

( মীযানুল ইতিদালঃ খ-২, পৃ-৪৭৭; তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩২৬ )

৮। আহমদ ইবনু সালেহ বলেনঃ

“ ইবনু লাহীআহ ছিক্বাহ। তাঁর বর্ণিত যেসব হাদীছে মিশ্রণ রয়েছে সেই মিশ্রণকে প্রত্যাখান করা হবে। ”

( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-৫, পৃ-৩৩১ )

সারকথাঃ

উল্লেখিত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কোন কোন কট্টরপন্থী মুহাদ্দিছ ইবনু লাহীআহকে দুর্বল আখ্যায়িত করলেও কিন্তু তাঁর দুর্বলতা এই পর্যায়ে নয় যে, তাঁর বর্ণিত হাদীছ একেবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। উপরন্তু বহু মুহাদ্দিছ তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন এবং তাঁর বর্ণিত হাদীছকে ‘হাসান’ স্তরের বিবেচনা করেছেন।

যেমনঃ হাফিয হাইসামী (রহঃ) বলেনঃ

“ … এখানে ইবনু লাহীআহ নামক একজন রাবী রয়েছে। একাধিক মুহাদ্দিছ তাঁর হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। ”

( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-১, পৃ-১৬ )

অন্যত্র তিনি লিখেনঃ

“ … হাদীছটি ইবনু লাহীআহ বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তবুও তার হাদীছ হাসান। ”

( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-১০২ )









বিশ্ব-বিখ্যাত মুফাসসিরগনের তফসীর থেকে শবে বরাতের প্রমান (পর্ব ২) :



কেউ কেউ এভাবে মতদ্বয়ের সমাধান করেছেন যে, শবে বরাতে কুরআন শরীফ লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়েছে। এর বর্ণনা সূরা দুখানে দেয়া হয়েছে। অতঃপর সেখান থেকে জিব্রাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে তা ক্বদরের রাতে রসূল (সঃ) এর উপর অবতীর্ণ হওয়া আরম্ভ হয়ে ২৩ বছরে তার সমাপ্তি ঘটেছে।


১।


উল্লেখ্য এখানে ইবনে আব্বাসের যে বর্ণনার দিকে হযরত (রহঃ) ইঙ্গিত করেছেন তা তাফসীরে মাযহারীতে এভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

“ আল্লাহ তাআলা সকল প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন শবে বরাতে এবং তা সংশ্লিষ্টদের নিকট সোপর্দ করেন ক্বদরের রাতে। ”

( দেখুন তাফসীরে মাযহারীঃ খ – ৮, পৃ – ৩৬৮ )




২।

এ মীমাংসার পক্ষে বিবরণ পাওয়া যায় আল্লামা আবুস সাউদ এর সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ تفسير ابى السعود তাফসীরে আবি সাউদ এর মধ্যে। তিনি বলেনঃ

“ মোবারক রাত থেকে উদ্দেশ্য হলো, শবে ক্বদর। কেউ কেউ বলেছেনঃ এর উদ্দেশ্য হল, শবে বরাত। এ রাতে কুরআনের অবতরণ আরম্ভ হয় অর্থাৎ এ রাত্রে পরিপূর্ণ কুরআন দুনিয়ার আসমানে লৌহে মাহফুজ থেকে একসঙ্গে অবতীর্ণ হয় এবং হযরত জিবরাইল (আঃ) তা তাখতির মধ্যে লিপিবদ্ধ করেন।

“ প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা হয় ” (এ ব্যাপারে বলেন) কেউ কেউ বলেছেনঃ

শবেবরাতে লওহে মাহফুজ থেকে লিখিতভাবে অবতরণ আরম্ভ হয় এবং শবে ক্বদরে গিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। রিযিকের বিষয়ে লিখিত তাখতী মিকাঈল (আঃ) কে দেয়া হয়। যুদ্ধ-বিবাদ বিষয়-সম্বলিত তাখতী জিবরাঈল (আঃ) কে অনুরূপ ভূমিকম্প, বিজলীর গর্জন, ভূমি ধসে পড়ার বিষয়গুলোও তাকে দেয়া হয় এবং সকল আমলের বিষয় দুনিয়ার আসমানের বিশিষ্ট ফেরেশতা ইসমাইলকে প্রদান করা হয়। বিপদ ও মুসিবতের বিষয়গুলো আযরাঈল (আঃ) কে প্রদান করা হয়। ”

( দেখুন তাফসীরে আবি সাউদঃ খ – ৬, পৃ – ৪৭ )

৩।

উক্ত মতের স্বপক্ষে তাফসীরে জালালাইনে বিবরণ পাওয়া যায় এভাবেঃ

“ মোবারক রাত অর্থ হচ্ছে, শবে ক্বদর অথবা মধ্য-শাবানের রাত যে রাতে কুরআন শরীফ সপ্তম আসমান থেকে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ হয়। ”

( দেখুন জালালাইন শরীফঃ পৃ – ৪০৮ )

৪।

ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী (রহঃ) এ ব্যাপারে সবিস্তারে আলোচনা করার পর মাসআলার শেষে বলেছেনঃ

“ বলা হয়েছে যে, শবে বরাতে লওহে মাহফুয হতে কুরআন অবতরণের কাজ শুরু হয় এবং শবে ক্বদরে এসে তার সমাপ্তি ঘটে। ”

( দেখুন তাফসীরে কবীরঃ খ – ১৪, পৃ – ৩৪১ )



৫।

অনুরূপ শেখ মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহঃ) তার স্বীয় গ্রন্থ “ মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ ” এবং “ মাজালিসুল আবরার ” গ্রন্থদ্বয়ে সূরা দুখানের আয়াতসমূহ থেকে শবে বরাত উদ্দেশ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন।

( দেখুন মাজালিসুল আবরারঃ পৃ – ১৭৭ )


আল্লামা আব্দুলহক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) ما ثبت بالسنة এর বিবরণটি নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

“ অধিকাংশ উলামাদের মতামত হলো, কুরআন অবতরণ ও প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা শবে ক্বদরে সম্পন্ন হলেও এসব বিষয় আরম্ভ হয়েছে শবে বারাত তথা মধ্য শাবানের রাতে। ”

( দেখুন হাকীকতে শবে বরাতঃ পৃ – ৮ )


বিশ্ব-বিখ্যাত মুফাসসিরগনের তফসীর থেকে শবে বরাতের প্রমান (পর্ব ১) :



আয়াতগুলো প্রথমে অর্থসহ পেশ করা হচ্ছে।



★ আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-

انا انزلنه فى ليلة مبركة انا كنا منذرين. فيها يفرق كل امر حكيم. امرا من عندنا انا كنا مرسلين.

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে (শবে বরাতে) কুরআন শরীফ নাযিল করেছি অর্থাৎ নাযিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমিই ভয় প্রদর্শনকারী। উক্ত রাত্রিতে আমার পক্ষ থেকে সমস্ত প্রজ্ঞাময় কাজ গুলো ফায়সালা করা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী।” (সূরা দুখান-৩, ৪, ৫)

★ আয়াতে উল্লেখিত ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ (বরকতময় রাত) শব্দের ব্যাখ্যা বা তাফসীরকে কেন্দ্র করেই “ কুরআনের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত ” শীর্ষক আলোচনার সূত্রপাত।

★ লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে তার যথার্থ প্রমাণ সূরা দু’খানের ৪ নম্বর আয়াত শরীফ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ। এই আয়াত শরীফ এর يُفْرَقُ শব্দের অর্থ ফায়সালা করা। প্রায় সমস্ত তাফসীরে সকল মুফাসসিরীনে কিরামগণ يُفْرَقُ (ইয়ুফরাকু) শব্দের তাফসীর করেছেন ইয়ুকতাবু অর্থাৎ লেখা হয়, ইয়ুফাছছিলু অর্থাৎ ফায়সালা করা হয়, ইয়ুতাজাও ওয়াযূ অর্থাৎ বন্টন বা নির্ধারণ করা হয়, ইয়ুবাররেমু অর্থাৎ বাজেট করা হয়, ইয়ুকদ্বিয়ু অর্থাৎ নির্দেশনা দেওয়া হয় । কাজেই ইয়ুফরাকু-র অর্থ ও তার ব্যাখার মাধ্যমে আরো স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ দ্বারা শবে বরাত বা ভাগ্য রজনীকে বুঝানো হয়েছে। যেই রাত্রিতে সমস্ত মাখলুকাতের ভাগ্যগুলো সামনের এক বছরের জন্য লিপিবদ্ধ করা হয়, আর সেই ভাগ্যলিপি অনুসারে রমাদ্বান মাসের লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদরে তা চালু হয়। এজন্য শবে বরাতকে লাইলাতুত্ তাজবীজ অর্থাৎ ফায়সালার রাত্র এবং শবে ক্বদরকে লাইলাতুল তানফীয অর্থাৎ নির্ধারিত ফায়সালার কার্যকরী করার রাত্র বলা হয়। (তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে খাযীন, তাফসীরে ইবনে কাছীর, বাগবী, কুরতুবী, রুহুল বয়ান, লুবাব)


★ এজন্যে মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা শবে বরাতকে ليلة التجويز অর্থাৎ ‘ফায়সালার রাত।’ আর শবে ক্বদরকে ليلة التنفيذ অর্থাৎ ‘জারী করার রাত’ বলে উল্লেখ করেছেন। কেননা শবে বরাতে যে সকল বিষয়ের ফায়সালা করা হয় তা ‘সূরা দুখান-এর’ উক্ত আয়াত শরীফেই উল্লেখ আছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

فيها يفرق كل امر حكيم

অর্থাৎ- “উক্ত রজনীতে প্রজ্ঞাসম্পন্ন সকল বিষয়ের ফায়সালা করা হয়।” হাদীছ শরীফেও উক্ত আয়াতাংশের সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

فيها ان يكتب كل مولود من بنى ادم فى هذه السنة وفيها ان يكتب كل هالك من بنى ادم فى هذه السنة وفيها ترفع اعمالـهم وفيها تنزل ارزاقهم.

অর্থাৎ- “বরাতের রাত্রিতে ফায়সালা করা হয় কতজন সন্তান আগামী এক বৎসর জন্ম গ্রহণ করবে এবং কতজন সন্তান মৃত্যু বরণ করবে। এ রাত্রিতে বান্দাদের আমলগুলো উপরে উঠানো হয় অর্থাৎ আল্লাহ পাক উনার দরবারে পেশ করা হয় এবং এ রাত্রিতে বান্দাদের রিযিকের ফায়সালা করা হয়।” (বায়হাক্বী, মিশকাত)




★ প্রথম তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে কবীর

১।

ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ তাফসীরে কাবীরে সূরা দুখানের আয়াতে ( ليلة مباركة ) লাইলাতুম মুবারকাহ দ্বারা কোন রাত্র বুঝানো হল, এ ব্যাপারে উল্লেখ করেনঃ

“ এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মতে এটি হলো লাইলাতুল ক্বদর তথা শবে ক্বদর আর হযরত ইকরমা (রহঃ) সহ অপর একদল আলেমের মতে এ রাতটি হলো শবে বরাত আর তা হলো লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান। (মধ্য শাবানের রাত্রি) ”

( তাফসীরে কবীরঃ খ – ১৪, পৃ – ৩৩৮ )

২।

অতঃপর ইমাম রাযী (রহঃ) প্রথম মতের পক্ষে সবিস্তারে দলিল উল্লেখ করার পর বলেনঃ

“ (অতঃপর) যারা এ আয়াতের ليلة مباركة লাইলাতুম মুবারাকাহ এর অর্থ শবে বরাত করেছেন তাদের দৃষ্টিতে শাবানের মধ্য রাত্রের চারটি নাম প্রসিদ্ধ রয়েছে যথাঃ লাইলাতুম মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুস্‌সক ও লাইলাতুর রহমাহ। বলা বাহুল্য যে, লাইলাতুল বারআত এই জন্যই নামকরণ করা হয়েছে যে, টেক্স আদায়কারী, জনগণ থেকে পূর্ণ কর আদায় করে নেয়ার পর তাদেরকে “ বারাআত ” (অর্থাৎ দায়মুক্ত) লিখে দিতেন। তদ্রূপ আল্লাহ তাআলাও মুমিন বান্দাদেরকে এ রাত্রিতে ক্ষমা মার্জনা করে জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্ত বলে লিখে দেন তাই এ রাতকে শবেবরাত বলা হয়। ”

( তাফসীরে কবীরঃ খ – ১৪, পৃ – ২৩৯ )


★ দ্বিতীয় তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে রূহুল মাআনী


আল্লামা আলূসী (রহঃ) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে রূহুল মাআনীতে উল্লেখ করেছেনঃ

“ এবং হযরত ইকরামা ও আরো একদল মুফাসসিরীনেকেরাম বলেন যে, এ রাতটিই হলো শাবানের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাত। যার নাম রাখা হয়েছে, লাইলাতুররহমাহ, লাইলাতুমমুবারাকাহ, লাইলাতুস্‌সক (দায়মুক্তির রাত) এবং লাইলাতুল বারাআত (মুক্তি প্রাপ্তির রাত) দিয়ে যারা এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, তারা এর মর্যাদা সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হলো, যা ইমাম ইবনে মাজাহ ও ইমাম বায়হাকী (রহঃ) স্বীয় গ্রন্থ শুয়াবুল ঈমানে হযরত আলী (রঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেনঃ যখন মধ্য-শাবানের মধ্যরাত হবে তোমরা রাতভর ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে যাও এবং দিনে রোযা রাখ, কেননা আল্লাহ তাআলা এ রাত্রে সূর্যাস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, আর আহবান করতে থাকেন, কে আছ ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব, কে আছ রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দান করব, কে আছ যাচনাকারী? আমি তাকে দান করব। কেউ কি এরূপ আছ? কেউ কি এরূপ আছ? এভাবে ফজর পর্যন্ত আহবান করতে থাকেন। ”

(তাফসীরে রূহুল মাআনীঃ খ – ৯, পৃ – ১১০ অংশ ১২ )




★ তৃতীয় তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে রুহুল বায়ান

আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (রহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ রূহুল বয়ানে مباركة ليلة লাইলাতুমমুবারাকাহ শব্দ দ্বারা কোন রাতটিকে বুঝায়, এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতঃ এক দল মুফাসসিরীনের দৃষ্টিতে এ রাত থেকে লাইলাতুল বারাআত বুঝানো হয়েছে মর্মে বর্ণনা করার পর লিখেনঃ

“ কোন কোন তাফসীরকারক এখানে লাইলাতুমমুবারাকাহ থেকে মধ্য-শাবানের রাত বুঝিয়েছেন। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য “ বারাআত ” নির্ধারণ করেন। যথাঃ বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) এ রাতে যখন নামায থেকে মাথা উঠিয়েছেন তখন একটি সবুজ রং এর কাগজ (হাতে) পেলেন যার নূরের রস্মি আসমান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানে লিখা ছিল “ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দা ওমর ইবনে আব্দুল আযীযের জন্য জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তির ঘোষণা দেয়া হলো। ” এবং এ রজনীতে নেক বান্দাদেরকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি দেয়া হয়, অনুরূপভাবে বদকার বান্দাদের আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত বলেও ঘোষণা দেয়া হয়। এ রজনীর আরো বহু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ”

( রূহুল বয়ানঃ খ – ৮, পৃ – ৪০৪ )

অতঃপর আল্লামা ইসহাক হক্কানী (রহঃ) শবে বরাতের প্রায় ছয়টি বৈশিষ্ট্য সবিস্তারে বর্ণনা করেন তাঁর এ তাফসীরে।



★ চতুর্থ তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে কুরতুবী

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ তাফসীরগ্রন্থ জামিউল আহকামিল বয়ান এ উল্লেখ করেনঃ

“ বরকতময় রাত্রি বলতে ক্বদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে। কেউ বলেছেন, সেটা মধ্য শা’বানের রাত। এবং এ রজনীর আরো চারটি নাম রয়েছে। যেমন লাইলাতুমমুবারাকাহ, লাইলাতুলবারাআত, লাইলাউস্‌সক, লাইলাতুররহমাহ। হযরত ইকরামা বলেছেন, এ আয়াতে লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ মধ্য শাবানের রাত্রি। তবে প্রথম মতটি অধিক শুদ্ধ।

فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

অর্থাৎ আমারই নির্দেশক্রমে উক্ত রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ে ফয়সালা করা হয়।

ইবনে আব্বাস (রঃ) বলেনঃ এর অর্থ দুনিয়াবী প্রজ্ঞাসম্পন্ন বস্তুর ফয়সালা আগামী ক্বদরের রাত পর্যন্ত গৃহীত হয়।

হযরত ইকরামা বলেনঃ এ প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা মধ্য শা’বানের রাতেই করা হয় এবং পূর্ণ বছরের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা হয়। জীবিতদেরকে মৃত্যুবরণকারীদের থেকে পৃথক করা হয়। ”

( তাফসীরে কুরতুবীঃ খ – ১৬, পৃ – ৮৫ )



★ পঞ্চম তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে তবরী

ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জাবীর তাবারী (রহঃ) তার প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেনঃ

“ লাইলাতুমমুবারাকাহ এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাফসীরকারকগণের মতভেদ রয়েছে যে, রাতটি বছরের কোন রাত? কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ শবে ক্বদর (অতঃপর তাদের দলীল পেশ করেছেন) এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেছেনঃ রাতটি মধ্য-শা’বানের রাত।

فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

“ সে রাত্রে সকল প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। ”

এ আয়াতেও সে ‘ রাত ’ বলতে কোন রাত বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়েও মুফাসসিরগণের মতভেদ রয়েছে। (যেমন মতভেদ ছিল مباركة ليلة লাইলাতুমমুবারাকার মধ্যে)

কেউ কেউ বলেছেনঃ এ আয়াতেও রাত থেকে শবে কদরকে বুঝানো হয়েছে। আবার কারো কারো মতে এ আয়াতেও শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে। ”

( তাফসীরে তবরীঃ খ – ১১, পৃ – ২২১-২২২ )

ইমাম ইবনে জারীর প্রত্যেক মতের স্বপক্ষে বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন – যা এখানে উল্লেখ করার অবকাশ নেই।


★ ষষ্ঠ তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে বগবী


ইমাম বাগাভী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করেনঃ

“ লাইলাতুমমুবারাকাহ সম্পর্কে কাতাদাহ, ইবনে জায়েদ (রহঃ) বলেছেন যে, এটা কদরের রাত্র। তবে অন্যান্য মুফাসসির বলেছেন, লাইলাতুম মুবারাকাহ এর অর্থ মধ্য-শাবানের রাত। এবং হযরত ইকরামা (রহঃ) বলেছেনঃ মধ্য-শাবানের রাত্র, যাতে পূর্ণ বৎসরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। ”

( তাফসীরে বাগাভীঃ খ – ৪, পৃ – ১১১ )



★ সপ্তম তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে খাযেন


ইমাম খাযেন (রহঃ) তার তাফসীর গ্রন্থে লাইলাতুম মুবারাকাহ এর সম্পর্কে উল্লেখ করেনঃ

“ হযরত ইবনে জায়েদ (রহঃ) বলেনঃ লাইলাতুমমুবারাকাহ তা হলো শবে ক্বদর। অন্যান্য তাফসীরকারক বলেছেনঃ রাতটি মধ্য শাবানের রাত। এবং হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন রাতটি মধ্য-শাবানের রাত যেখানে পূর্ণ বৎসরের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ের ফয়সালা হয় এবং জীবিত ব্যক্তিদেরকে মৃত ব্যক্তিদের থেকে পৃথক করা হয়। ”

( তাফসীরে খাযেনঃ খ – ৪, পৃ – ১৪৩ )


★ অষ্টম তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে ইবনে কাছীর


ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ) তার স্বীয় গ্রন্থ তাফসীরে কুরআনুল আযীমে উল্লেখ করেছেনঃ

“ বরকতময় রাত বলতে শবে ক্বদরকে বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমি কুরআনে করীম শবে ক্বদরে নাযিল করেছি এবং কুরআন রমজান মাসেই নাযিল করেছি।
আর যারা বলেন, বরকতময় রাত বলতে মধ্য শা’বানের রাতকে বুঝানো হয়েছে – যেমনটি ইকরামাহ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে – তাদের কথা সত্য থেকে বহু দূরে এবং যে হাদীছটি উছমান ইবনে আখনাস থেকে বর্ণিত অর্থাৎ “ এক শাবান মাস হতে অন্য শাবান মাস পর্যন্ত মানুষের হায়াত মাউত ও রিযিকের বার্ষিক ফয়সালা হয়ে থাকে এমনকি কোন লোক বিবাহ করে এবং বাচ্চাও জন্ম গ্রহণ করে অথচ সে জানে না তার নাম মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। ” এ হাদীছটি মুরসাল (অর্থাৎ হাদীছটিতে রসূল (সঃ) থেকে বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ নেই।) এ ধরণের হাদীছ দ্বারা সহীহ হাদীছকে খন্ডন করা যায় না। ”

( তাফসীরে ইবনে কাছীরঃ খ – ৪, পৃ – ১৪৮ )



শবে বরাতের ফজীলত সম্পর্কিত হাদিস যারা যারা বর্ননা করেছেন :

এখানে শুধু বর্ননা কারী গনে নাম ও কিতাবের নাম এক সাথে দেয়া হল।  অন্য পর্ব গুলোতে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।


শবে বরাত ও কোরআনঃ



পবিত্র কোরআনের ২৫ তম পারা ও ৪৪ নং সূরা “ দুখানের ” শুরুতে যে পাঁচটি আয়াত রয়েছে সে আয়াতগুলোই মূলত শবে বরাত ও পবিত্র কোরআন - এ বিষয়ক আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু।



১। তাফসীরে কবীর

২। তাফসীরে রুহুল মাআনী

৩। তাফসীরে রুহুল বায়ান

৪। তাফসীরে কুরতুবী

৫। তাফসীরে তবরী

৬। তাফসীরে বগবী

৭। তাফসীরে খাযেন

৮। তাফসীরে ইবনে কাসির ইত্যাদি



শবে বরাত ও সাহাবায়ে কেরাম (রঃ)



শবে বরাতের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদীছসমূহের বর্ণনাকারিদের মধ্যে অনেক বড় বড় ( এক ডজনের মত ) সাহাবাও রয়েছেন। যাদের কয়েকজনের পবিত্র নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ



ক) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রঃ)

খ) হযরত আলী (রঃ)

গ) হযরত আয়েশা (রঃ)

ঘ) হযরত আবু হুরায়রা (রঃ)

ঙ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আ’মর (রঃ)

চ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ)

ছ) হযরত আউফ ইবনু মালিক (রঃ)

জ) হযরত মুআয ইবনু জাবাল (রঃ)

ঝ) হযরত আবু ছালাবাহ আল খুসানী (রঃ)

ঞ) কাছীর ইবনে মুররা আল হাজরমী (রঃ)



শবে বরাত ও তাবেয়ীঃ



শামের বিশিষ্ট তাবেয়ী যেমনঃ



ক) হযরত খালেদ ইবনে মা'দান (রহঃ)

খ) ইমাম মাকহূল (রহঃ)

গ) লোকমান ইবনে আমের (রহঃ)



প্রমূখ উচ্চমর্যাদাশীল তাবেয়ীগণ শা'বানের পনেরতম রজনীকে অত্যন্ত মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতেন এবং এতে খুব বেশী বেশী ইবাদত ও বান্দেগীতে মগ্ন থাকতেন বলে গ্রহণযোগ্য মত পাওয়া যায়।



শবে বরাত ও সিহাহ সিত্তাহঃ

সিহাহ সিত্তারই দুটি কিতাব - তিরমিযী শরীফ ও সুনানে ইবনে মাজাহতে শুধু যে শবে বরাত এর ফজীলত সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত আছে তা নয়, বরং ইমাম তিরমিযী (রহঃ) তাঁর তিরমিযী শরীফে এবং ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁর সুনানে পনের শাবানের ফজীলত নিয়ে আলাদা বাব বা অধ্যায়ই লিখেছেন।



শবে বরাত ও অন্যান্য বিখ্যাত মুহাদ্দিস গনের হাদীছগ্রন্থঃ



সিহাহ সিত্তার বাইরেও অনেক ইমামগণ তাদের জগতবিখ্যাত বড় বড় হাদীসগ্রন্থে শবে বরাত ও তার ফজীলত নিয়ে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ



১। ইমাম তাবরানী রচিত "আল কাবীর" এবং "আল আওসাত"

২। ইমাম ইবনে হিব্বান রচিত "সহীহ ইবনে হিব্বান"

৩। ইমাম বায়হাকী রচিত "শুআবুল ঈমান"

৪। হাফেয আবু নুআইম রচিত "হিলয়া"

৫। হাফেয হায়ছামী রচিত "মাজমাউয যাওয়ায়েদ"

৬। ইমাম বাযযার তাঁর "মুসনাদ" এ

৭। হাফিয যকী উদ্দীন আল মুনযিরী রচিত "আততারগীব ওয়াত-তারহীব"

৮। ইমাম আহমদ তাঁর "মুসনাদ" এ

৯। মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা

১০। হাফেয আব্দুর রাজ্জাক এর "মুসান্নাফ" এ



আমরা শবে বরাতের ফজীলত সম্পর্কিত বহু হাদীস দেখতে পাই।



শবে বরাত ও কিতাবঃ



মুসলিম বিশ্বের মহামনীষীগণ কুরআন করীমের নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থ, হাদীছের ব্যাখ্যাগ্রন্থ এবং প্রায় বড় বড় আলেম নিজেদের রচিত কিতাবাদীতে কেউ সংক্ষেপিত আকারে কেউ বা সবিস্তারে শবেবরাতের ফজীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁরা যেমন শবেবরাতে করণীয় ও বর্জনীয় দিকসমূহ আপন আপন গ্রন্থে লেখেছেন তেমনি বাস্তব জীবনে রাতটিকে কিভাবে চর্চায় আনা হবে তার নমুনা দেখিয়ে গেছেন।



যেমনঃ



ক) পাঁচশত হিজরীর ইমাম গাযালী (রহঃ) রচিত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন ( الدين علوم احياء )

খ) ৬০০ হিজরীর প্রারম্ভে হযরত বড়পীর আব্দুল ক্বাদের জ্বীলানী (রহঃ) এর গুনিয়াতুত তালেবীন

( الطالبين غنية )

গ) ৭০০ হিজরীর ইমাম মুহাম্মদ আল জাযারী (রহঃ) এর আদদোয়াউ ওয়াস সালাত ফী যওইল কুরআন ওয়াস সুন্নাহ ( والسنة القرآن ضوء فى والصلوة الدعاء )

ঘ) ৭০০ হিজরীর ইমাম আবু জাকারিয়া ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে শারফুদ্দীন নববী (রহঃ) এর রিয়াজুস সালেহীন

( الصالحين رياض )

ঙ) এগারশত হিজরীর শায়েখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) এর মা ছাবাতা বিস সিন্নাহ ( بالسنة ثبت ما)

চ) তেরশত হিজরীর মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রচিত মিফতাহুল জান্নাহ ( الجنة مفتاح )

ছ) চৌদ্দশত হিজরীর হযরত আশরাফ আলী থানভী এর ওয়াজ ও তাবলীগ ( وتبليغ وعظ )

জ) মুফতী আজম মুফতী মোহাম্মদ শফী এর হাকীকতে শবেবরাত ( براءت شب حقيقت )

ঝ) তাঁরই সন্তান আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ তাকী উছমানীর শবেবরাত ( براءت شب )

ঞ) মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ এর কুরআন-হাদীছের আলোকে শবেবরাত (গবেষণামূলক একটি অনবদ্য রচনা)



বিশ্ব-বিখ্যাত ইমামগণের মতে শবে বারাত বা লাইলাতুল বারা'ত :-




★ ইমাম শাফেয়ী রহ বলেন-

و بلغنا أنه كان يقال إن الرعاء يستجاب في خمس في ليال في ليلة جمعة و ليلة الأضحى و ليلة الفطر و اول ليلة من رجب و ليلة النصف من شعبان

আর আমাদের নিকট এরূপ বর্ণনা এসেছে যে, নিশ্চই পাঁচটি রাতে বান্দার দুআ’র জবাব দেয়া হয় অর্থাৎ দু’আ কবুল করা হয়, জুমার রাত, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহার রাত, রজবের প্রথম রাত এবং শাবানের মধ্য রাত (শবে বরাত)।
[আল উম্ম, ১:২৩১/২:৪৮৫, ইবনে রজব লাতায়িফুল মা’আরিফ ১:১৩৭]


★ খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয রাহঃ বসরায় তার গভর্নরকে লিখেন-

عليك بأربع ليال من السنة فإن الله يفرغ فيهن الرحمة إفراغا أول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة الفطر وليلة الأضحى

বছরে চার রাতের ব্যাপারে তোমার সতর্ক থাকা প্রয়োজন, কেননা আল্লাহ্‌ তা’আলা ঐ রাতগুলোতে তার রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন। তা হল, রজবের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রাত এবং ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত।
[ইবনে রজব লাতায়িফুল মা’আরিফ ১:১৩৭]


★ ওহাবী‬ ও সালাফী ইমাম ইবনে তাইয়িমাহ তাঁর স্বীয় ফতোয়া গ্রন্থে লিখেছেন-

إذَا صَلَّى الْإِنْسَانُ لَيْلَةَ النِّصْفِ وَحْدَهُ أَوْ فِي جَمَاعَةٍ خَاصَّةٍ كَمَا كَانَ يَفْعَلُ طَوَائِفُ مِنْ السَّلَفِ فَهُوَ أَحْسَنُ

যদি কোন ব্যক্তি একাকী অথবা নির্দিষ্ট জামাতের সাথে শা’বানের মধ্য রাতে ইবাদত করে যেমনটা সালফে সালেহীনগণ করতেন অবশ্যই তা অধিক উত্তম হবে।
[মাজমাউ’ল ফতওয়া ফতোয়ায়ে তাইয়িমাহ,২৩তম খণ্ড,১৩১ পৃষ্ঠা]

★ তিনি আরো বলেন,

وَأَمَّا لَيْلَةُ النِّصْفِ فَقَدْ رُوِيَ فِي فَضْلِهَا أَحَادِيثُ وَآثَارٌ وَنُقِلَ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْ السَّلَفِ أَنَّهُمْ كَانُوا يُصَلُّونَ فِيهَا فَصَلَاةُ الرَّجُلِ فِيهَا وَحْدَهُ قَدْ تَقَدَّمَهُ فِيهِ سَلَفٌ وَلَهُ فِيهِ حُجَّةٌ فَلَا يُنْكَرُ مِثْلُ هَذَا

শাবানের মধ্য রাতের ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদীস এসেছে,আছার তথা সাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা, তাবে তাবেঈগন সালফে সালহীগনের বক্তব্য রয়েছে আর তারা এই রাতে ইবাদত করতেন। সালফে সালেহীনদের মধ্যে এ রাতে ইবাদতের ব্যাপারে আন্তরিকতা ও একাগ্রতা পাওয়া যায় এবং এ ব্যাপারে (শবে বরাত) কোন নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায় নি।
[মাজমাউ’ল ফতওয়া ফতোয়ায়ে তাইয়িমাহ,২৩তম খণ্ড,১৩২ পৃষ্ঠা]


★ এমনিভাবে ফিক্বহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব আদ্দুররুল মুখতারে শবে বরাতের সম্পর্কে বলা হয়েছে।
[১ম খণ্ড,২৪-২৫ পৃষ্ঠা]

★ হাম্বলী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ ফক্বীহ আল্লামা শায়খ মানসূর ইবনু ইউনুস (রহঃ) লিখেনঃ

” হ্যাঁ, শাবানের পনের তারিখের রাত সম্বন্ধে ফজীলতের কথা বিদ্যমান। সলফে সালেহীন এই রাতে নামায পড়তেন। কিন্তু এ রাতে জাগরণের লক্ষ্যে মসজিদে জমায়েত হওয়া বিদআত। এ রাতে জাগরণ থেকে ইবাদত করার ফজীলত ঠিক দুই ঈদের রাতে জাগরণ থেকে ইবাদত করার ফজীলতের মতই। “

★ আল্লামা ইসহাক ইবনুল মুফলিহ (মৃঃ ৮৮৪ হিঃ) বলেনঃ

” হাদীছের কারণে মাগরিব এবং ইশার মাঝখানে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব। অনেকেই বলেছেন, আশূরার রাত, রজবের প্রথম তারিখ রাত এবং শা‘বানের পনের তারিখ রাতেও জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব। ”

★ ফিক্বহে হানাফীর ইমাম মুহাম্মদ ইবনু আলী আল হাসফাকী (মৃঃ ১০৮৮ হিঃ) বলেনঃ

” সফরের পূর্বে দু’রাকআত, সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করে দু’রাকআত, দুই ঈদের রাতে, শাবানের পনের তারিখে, রমজানের শেষ দশ রাতে এবং জিলহজ্বের প্রথম তারিখে জাগ্রত থেকে ইবাদত কতা মুসতাহাব। ”

★  আল্লামা ইবনু নুজাইম হানাফী (মৃঃ ৯৭০ হিঃ) বলেনঃ

” রমজানের শেষ দশ রাতে দুই ঈদের রাতে, পহেলা জিলহজ্ব রাতে, শাবানের পনের তারিখ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুসতাহাবের অন্তর্ভুক্ত। যেমনটি হাদীছসমূহে এসেছে। ”

★ আল্লামা হাসান ইবনু আম্মার ইবনু আলী আশ-শারাম্বলালী আল হানাফী (মৃঃ ১০৬৯ হিঃ) বলেনঃ

” শাবানের পনের তারিখ রাত জেগে ইবাদত করা মুস্তাহাব। ”

★ শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিছে দেহলভী স্বীয় গ্রন্থ ( ماثبت بالسنة فى أيام السنة ٣٦٠ ) তে কিছু হাদীছ এবং তাবিঈনদের কিছু বক্তব্য ও আমল নকল করার পর বলেনঃ

” … সুতরাং উল্লেখিত হাদীছসমুহের ভিত্তিতে এই রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব।ফাজাইলে আ’মালের ক্ষেত্রে এ ধরনের হাদীছের উপর আমল করা যায়। ”


★ অনুরূপ শেখ মুহাদ্দিছে দেহলভী (রহঃ) তার স্বীয় গ্রন্থ “ মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ ” এবং “ মাজালিসুল আবরার ” গ্রন্থদ্বয়ে সূরা দুখানের আয়াতসমূহ থেকে শবে বরাত উদ্দেশ্য বলে সাব্যস্ত করেছেন।

( দেখুন মাজালিসুল আবরারঃ পৃ – ১৭৭ )


★ আল্লামা আব্দুলহক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) ما ثبت بالسنة এর বিবরণটি নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

“ অধিকাংশ উলামাদের মতামত হলো, কুরআন অবতরণ ও প্রতিটি প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফয়সালা শবে ক্বদরে সম্পন্ন হলেও এসব বিষয় আরম্ভ হয়েছে শবে বারাত তথা মধ্য শাবানের রাতে। ”

( দেখুন হাকীকতে শবে বরাতঃ পৃ – ৮ )


★ আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা তার ফাতওয়াতে লিখেনঃ

সাহাবারা, তাবেঈনরা, সালাফরা এ রাত অনেক গুরুত্বের সাথে পালন করে এসেছেন।

( ২৩ খ, ১৩২ পৃ)

” পূর্ববর্তী যুগের অনেক উলামাই এ রাতের ফযীলতকে গ্রহণ করেছেন। যেসব বুজুর্গানে দ্বীনরা এই রাতের ফজীলত সম্পর্কে একমত হয়েছেন, তাদের মধ্যে উমর বিন আব্দুল আযীয, ইমাম আল শাফী, ইমাম আল আওযায়ী, আতা ইবনে ইয়াসার, ইমাম আল মাজদ বিন তাইমিয়্যাহ, ইবনে রজব আল হাম্বলী এবং হাফিয যয়নুদ্দীন আল ইরাকী (রহঃ) অন্যতম। ”

( লাতাইফুল মারিফ, হাফিজ ইবনে রজবঃ পৃ-২৬৩,২৬৪; ফাতহুল ক্বাদীরঃ খ-২, পৃ-৩১৭ )


★” ইমাম শাফেঈ বলেছেন, আমি এসব রাতে পূর্ববর্তীরা যা কিছু আমল করতো বলে বর্ণনা করেছি তাসবই মুস্তাহাব মনে করি, ফরজ নয়। ”

( আল মাজমু )

★ ইমাম সুয়ুতী (রহঃ) তাঁর ‘হাকীকত আল সুন্নাহ ওয়াল বিদাহ’ তে বলেনঃ

” শাবান মাসের মাঝ রাত সম্পর্কে, এর অনেক ফযীলত রয়েছে এবং এর কিছু অংশ অতিরিক্ত ইবাদতে কাটানো মুস্তাহাব। ”

( হাকীকত আল সুন্নাহ ওয়াল বিদাহ আও আল আমর বি আল ইত্তিবা ওয়া আল নাহি আনাল ইবতিদা (১৪০৫/১৯৮৫ সংস্করণ), পৃ-৫৮ )

তিনি আরও লিখেনঃ

” এটি একাকী করতে হবে, জামাআতের সাথে নয়। ”