Wednesday, May 27, 2015

মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে ফেকাহশাস্ত্র ও ফকীহ ইমামগণের মর্যাদা (পর্ব ১) :-



★ ইবনে হিব্বান রহ. নিজ সনদে আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে ওহাব রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,

لقيت ثلاث مائة عالم وستين عالما ، ولولا مالك والليث لضللت في العلم

“আমি তিনশ’ ষাট জন আলেম থেকে ইলম অর্জন করেছি। কিন্তু যদি ইমাম মালেক রহ. ও ইমাম লাইস রহ. এর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হতো তবে আমি গোমরাহ হয়ে যেতাম।”[১]

★ ইবনে হিব্বান রহ. তার থেকে আরও বর্ণনা করেছেন,

اقتدينا في العلم بأربعة : اثنان بمصر واثنان بالمدينة : الليث بن سعد ، وعمرو بن الحارث بمصر ; ومالك والماجشون يالمدينة ، ولولا هؤلاء لكنا ضالين .

“আমি ইলম অর্জনে চারজনের অনুসরণ করেছি। দু’জন মিশরের এবং দু’জন মদিনার। ইমাম লাইস বিন সা’দ এবং আমর বিন হারেস ছিলেন মিশরীয়। ইমাম মালেক রহ. এবং ইমাম মাজিশুন ছিলেন মদিনার অধিবাসী। তারা যদি না থাকতেন, তবে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম।”

*** ইমাম ইবনে আবি হাতেম এবং ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. তাঁর থেকে এজাতীয় বক্তব্য বর্ণনা করেছেন। আল্লামা কাউসারি রহ. ভ্রষ্টতার কারণ বিশ্লেষণ করে উক্ত বক্তব্যের উপর আল-ইনতেকা-এ টীকা সংযোজন করেছেন। ইবনে আসাকির রহ. নিজ সনদে ইবনে ওহাব রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, ইমাম মালেক বিন আনাস এবং লাইস বিন সা’য়াদ যদি না থাকতেন, তবে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। আমি ধারণা করতাম রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে সকল হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলোর উপর আমল করা হবে।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম। ইমাম কাউসারি রহ. বলেন, ফিকাহ থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক রাবির ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে, যারা কোন হাদিসটি আমলযোগ্য এবং কোনটি আমলযোগ্য নয়, তা পার্থক্য করতে পারত না।” [২]


★ কাজি ইয়াজ রহ. ইবনে ওহাব রহ. এর বক্তব্যটি এভাবে বর্ণনা করেছেন,

قال ابن وهب: لولا أن الله أنقذني بمالك والليث لضللت. فقيل له: كيف ذلك؟ قال: أكثرت من الحديث فحيرني. فكنت أعرض ذلك على مالك والليث، فيقولان لي: خذ هذا ودع هذا.

“ইমাম ইবনে ওহাব রহ. বলেন, আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে ইমাম মালেক ও লাইস বিন সা’য়াদের মাধ্যমে রক্ষা না করতেন, তবে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কীভাবে? তিনি বলেন, আমি অনেক হাদিস বর্ণনা করতাম। ফলে আমি পেরেশান হয়ে যেতাম।[৩]

★ তখন আমি হাদিসগুলো ইমাম মালেক ও ইমাম লাইস বিন সায়াদের কাছে পেশ করতাম। তখন তারা আমাকে বলতেন, এটি গ্রহণ করো এবং এটি ছেঁড়ে দাও।”[৪]

★ একারণে সুফিয়ান সাউরি রহ. এই চিন্তাগত পেরেশানির আশঙ্কা এবং এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন,

تفسير الحديث خير من سماعه

“হাদীসের ব্যাখ্যা শিখা অধিক হাদিস শোনা থেকে উত্তম।”[৫]

★ ইমাম আবু আলী নিসাপুরি রহ. বলেন,

الفهم عندنا أجل من الحفظ

অর্থাৎ আমাদের নিকট হাদিস মুখস্থের চেয়ে হাদিসের বুঝ অর্জন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।[৬]

★ এক ব্যক্তি ইবনে উকদা রহ. কে একটা হাদিস সম্পর্র্কে জিজ্ঞাসা করলো। তিনি বললেন, এজাতীয় হাদিস কম বর্ণনা করো। কেননা এগুলোর বর্ণনা তার জন্যই কেবল শোভনীয় যে এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। ইহইয়া বিন সুলাইমান আব্দুল্লাহ বিন ওহাব থেকে, তিনি হজরত ইমাম মালেক রহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি ইমাম মালেক রহ. কে বলতে শুনেছি, অনেক হাদিস ভ্রষ্টতার কারণ হয়। আমি এমন কিছু হাদিস বর্ণনা করেছি যার প্রত্যেকটি বর্ণনার পরিবর্তে দু’টি বেত্রাঘাত খেতে বেশি পছন্দ করি।” [৭] [৮]


★ ইমাম মালেকের উক্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় শায়খ আল্লামা ইসমাইল আল-আনসারি বলেছেন, হাদিস ভ্রষ্টতার কারণ তার জন্যই হয়, যে হাদিসকে অপাত্রে ব্যবহার করে এবং অনুপযুক্ত স্থানে তা প্রয়োগ করে। নতুবা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহের মাঝে তো শুধু হেদায়েতই রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

وَاتَّبِعُوه لَعَلكم تَهْتَدُون

অর্থাৎ তোমরা তাঁর অনুসরণ করো, অবশ্যই হেদায়াত প্রাপ্ত হবে। কেউ যদি কোন জিনিস উপযুক্ত স্থানে রাখার পরিবর্তে অন্য জায়গায় রাখে, তবে সে পথভ্রষ্ট হবে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নতকে হিকমা বলেছেন। আর হিকমা বলা হয় কোন জিনিস তার উপযুক্ত স্থানে রাখা।

আল-জামে লি আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে-তে রয়েছে, ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেন,

قيل لمالك ابن انس إن عند بن عيينة عن الزهري اشياء ليست عندك فقال مالك وأنا كل ما سمعته من الحديث احدث به الناس أنا إذا اريد ان اضلهم

“ইমাম মালেক রহ. কে বলা হলো, ইমাম ইবনে উয়াইনা রহ. এর কাছে ইমাম যুহরীর রহ. অনেক হাদিস রয়েছে, যা আপনার কাছে নেই। ইমাম মালেক রহ. বললেন, আমি যেসব হাদিস শুনেছি, তার সব যদি মানুষের নিকট বর্ণনা করি, তবে আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো।[৯]



★ এ কারণে আল্লামা ইবনে ওহাব রহ. বলেছেন,

الحَدِيْثُ مَضلَّةٌ إِلا لِلْعُلَمَاءِ

অর্থাৎ আলেমগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদিস ভ্রষ্টতার কারণ।[১০]
 এখানে আলেম দ্বারা ফকিহ উদ্দেশ্য।

★ এবিষয়ে ইমাম ইবনে উয়াইনা রহ. এর বক্তব্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুতরাং সন্দেহ থাকে না যে, হাদিসের প্রকৃত বুঝ অর্জন করেছে ফকিহগণ। তাঁদের অনুসরণ ও সংশ্রব মানুষকে বক্রতা ও ভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত রাখবে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন বিখ্যাত দুই ইমাম, ইবনে উয়াইনা ও ইবনে ওহাব রহ। অন্যান্য ইমামগণ তাদের এ বক্তব্য উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখের মাধ্যমে এর স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। যেমন ইবনে উয়াইনা রহ. থেকে ইবনে আবি যায়েদ কাইরাওয়ানি, ইমাম খলিল আল-জুন্দি, ইবনে হাজার হায়তামি রহ. বর্ণনা করেছেন। আল্লামা ইবনে ওহাবের বক্তব্যটি বর্ণনা করেছেন, ইবনে আবি হাতেম, ইবনে হিব্বান, ইবনে আবি যায়েদ, ইমাম বাইহাকি, ইবনে আব্দুল বার, কাজি ইয়াজ, ইবনে আসাকির ও ইবনে রজব হাম্বলি রহ. সহ প্রমুখ আলেম।
আল্লামা ইবনে আব্দুল বার আত-তামহীদে[১১]

★ আবু জা’ফর আইলির সূত্রে যে বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন, সেখানে আবু জাফর আইলি বলেছেন, আমি ইবনে ওহাব রহ. কে অসংখ্যবার একথা বলতে শুনেছি। একারণে আমি যে উৎসগুলো থেকে উক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি, সেখানে ইবনে ওহাব রহ. এর বক্তব্যটি বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ উদাসীন মহল এ থেকে বড়ই আশ্চর্যজনকভাবে উদাসীন রয়েছে।

★ ইমাম তিরমিযি রহ. সুনানে তিরমিযিতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্যা যয়নব রা. এর গোসলের বর্ণনা সম্বলিত উম্মে আতিয়্যা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেছেন। এবং এর উপর দীর্ঘ আলোচনা করে শেষে লিখেছেন,

وَكَذِلِكَ قَالَ الفُقَهَاءُ وَهُمْ أَعْلَمُ بِمَعَانِي الحَدِيْثِ

অর্থাৎ ফুকাহায়ে কেরাম এমনটি বলেছেন, তারা হাদিসের প্রকৃত অর্থ সম্পর্র্কে সর্বাধিক জ্ঞাত।[১২]

★ খতিব বাগদাদি রহ. আল-ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ-এ লিখেছেন,

وليعلم أن الإكثار من كتب الحديث وروايته لا يصير به الرجل فقيها , وإنما يتفقه باستنباط معانيه , وإنعام التفكير فيه

“জেনে রেখো, বেশি বেশি হাদীস লেখা ও অধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনা দ্বারা কেউ ফকিহ হয়ে যায় না। বরং হাদিসের অর্থ আহরণ এবং তা নিয়ে গভীর গবেষণা দ্বারাই ফকিহ হওয়া যায়।”

অতঃপর তিনি ইমাম মালেক থেকে সনদসহ বর্ণনা করেছেন, তিনি তার দুই ভাগ্নে আবু বকর ইবনে আবি উয়াইস এবং ইসমাইল ইবনে আবি উয়াইসকে ওসিয়ত করেছেন।

أراكما تحبان هذا الشأن وتطلبانه ؟ ” قالا : نعم , قال : ” إن أحببتما أن تنتفعا به , وينفع الله بكما , فأقلا منه , وتفقها ”

তিনি তাদেরকে বললেন,“তোমাদের দু’জনকে দেখছি, তোমরা হাদিস সংকলন, তা শ্রবণ এবং অন্বেষণ অধিক পছন্দ করো? তারা বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা যদি পছন্দ করো যে, তোমরা তা থেকে উপকৃত হবে এবং আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দ্বারা অন্যের উপকার করবেন, তবে কম হাদিস বর্ণনা করো এবং হাদিসের বুঝ তথা ফিকাহ বেশি অর্জন করো।”[১৩]

এজন্য ইমাম মালেক রহ. হাদিস গ্রহণের পূর্বে যাচাই করতেন। তিনি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে রাবি সিকা ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার পাশাপাশি দেখতেন সে ফকিহ কি না। এবং বর্ণিত হাদিস সম্পর্র্কে তার বুঝ আছে কি না।

★ কাজি ইয়াজ রহ.তারতিবুল মাদারেকে উল্লেখ করেছেন, ইবনে ওহাব রহ. বলেন, ইমাম মালেক রহ. আত্তাফ বিন খালেদ সম্পর্র্কে অবগত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিস। ইমাম মালেক রহ. বললেন, তোমরা কি তার কাছ থেকে হাদিস গ্রহণ করো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমরা ফকিহ ছাড়া অন্যের কাছ থেকে হাদিস গ্রহণ করি না।”[১৫]

এক্ষেত্রে ইমাম মালেকের আদর্শ হলেন, তাঁর উস্তাদ ইমাম রবীয়াতুর রায় রহ.।

★ খতিব বাগদাদি রহ. আল-কিফায়াতে নিজ সনদে ইমাম মালেক থেকে বর্ণনা করেছেন, ইমাম রবীয়া রহ. ইবনে শিহাব যুহরীকে বলেছেন, তুমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিস বর্ণনা করে থাকো, সুতরাং সতর্কতার সাথে তা মুখস্থ করবে।[১৬]

★ ইমাম মালেক রহ.তাঁর অপর উস্তাদ আমিরুল মু’মিনিন ফিল হাদিস ইমাম আবুয যিনাদ আব্দুল্লাহ বিন যাকওয়ান রহ.এরও অনুসরণ করেছেন। আবুয যিনাদ রহ. থেকে ইবনে আব্দুল বার রহ. নিজ সনদে উল্লেখ করেছেন,

وأيم الله إن كنا لنلتقط السنن من أهل الفقه والثقة ونتعلمها شبيها بتعلمنا آي القرآن

“আল্লাহর শপথ, আমরা ফকিহ ও সিকা রাবিদের থেকে হাদিস গ্রহণ করতাম এবং সেগুলো পবিত্র কুরআনের আয়াতের মতো শিখতাম।”[১৭]




All References:-


=======
[১] আল-মাজরুহীন, খ.১, পৃ.৪২।
[২] ইমাম হাযেমী রহ. কৃত শুরুতুল আইম্মাতিল খামসা এর উপর ইমাম যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর টীকা সংযোজন। পৃ.৩৬।
[৩] ইমাম তাজুদ্দিন সুবকী রহ. তাঁর ত্ববকাতে ইমাম আহমাদ বিন সালেহ আল-মিসরী থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন ওহার রহ. এক লাখ বিশ হাজার হাদীস সংকলন করেন। ত্ববাকাত, খ.২, পৃ.১২৮।
[৪] তারতীবুল মাদারেক, খ.২, পৃ.৪২৭।
[৫] জামেউ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাজলিহি, খ.২, পৃ.১৭৫।
[৬] তাযকেরাতুল হুফফায, পৃ.৭৭৬।
[৭] আল-ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কীহ খ.২, পৃ.৮০।
[৮] ইমাম হাকেম এটি ইমাম মালেক থেকে মা’রেফাতু উলুমিল হাদীসে বর্ণনা করেছেন। পৃ.৬১। এরপর তিনি লিখেছেন, ইমাম মালেক রহ. খুব অল্প হাদীস বর্ণনা এবং হাদীসের বর্ণনার ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল থাকা সত্ত্বেও হাদীস বর্ণনা থেকে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করছেন। তবে অন্যদের অবস্থা কী হবে, যারা অবলীলায় হাদীস বর্ণনা করে থাকে।
[৯] ‘আল-জামে লিআখলাকির রাবী ও আদাবিস সামে, খ.২, পৃ.১০৯।
[১০] মূল বক্তব্যটি ইমাম মালেক রহ. এর।
[১১] আত-তামহীদ, খ.১, পৃ.২৬।
[১২] তিরমিযী শরীফ, খ.৩, পৃ.৩৭২। হাদীস নং ৯৯০।
[১৩] আল-ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কীহ, খ.২ পৃ.৮১-৮২। আল-মুহাদ্দিসুল ফাসিল, পৃ.২৪২, ৫৫৯।
[১৪] আল-ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কীহ, খ.১ পৃ.৮৩।
[১৫] তারতীবুল মাদারেক, খ.১, পৃ.১২৪-১৫।
[১৬] আল-কিফায়া, পৃ.১৬৯।
[১৭] জামেউ বয়ানিল ইলমি ওয়াফাযলিহি, খ.২, পৃ.৯৮।



No comments:

Post a Comment